গুপ্তমুদ্রা

গুপ্তলিখনভিত্তিক ডিজিটাল ইলেকট্রনীয় মুদ্রা যার কোনও কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা নেই
(ক্রিপ্টোকারেন্সি থেকে পুনর্নির্দেশিত)

গুপ্তমুদ্রা বা ক্রিপ্টোকারেন্সি হল বাইনারি উপাত্তের একটি সংকলন যা বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে কাজ করে। এর অস্তিত্ব শুধু ইন্টারনেট জগতেই বিদ্যমান। এটি ব্যবহার করে লেনদেন শুধু অনলাইনেই সম্ভব যার পুরো কার্যক্রম গুপ্তলিখন নামক একটি সুরক্ষিত প্রক্রিয়ায় সম্পন্ন হয়। ২০১৭ সাল থেকে এটি একটি উঠতি বাজারে পরিণত হয়েছে।

প্রথম বিকেন্দ্রীক গুপ্তমুদ্রা বিটকয়েনের একটি লোগো।

গুপ্তমুদ্রা এক ধরনের সমকক্ষ থেকে সমকক্ষ (পিয়ার টু পিয়ার) ব্যবস্থা। এতে তৃতীয় পক্ষের কোন নিয়ন্ত্রণ থাকে না। তাই কে কার কাছে এই ডিজিটাল মুদ্রা বিনিময় করছে তা অন্য কেউ জানতে পারে না। আবার পরিচয় গোপন রেখেও এটা দিয়ে লেনদেন করা যায়। তবে এর গুপ্তায়িত খতিয়ান (এনক্রিপটেড লেজার) সব লেনদেনকে ঝুঁকিপূর্ণ হওয়া থেকে নিয়ন্ত্রণ করে।

গুপ্তমুদ্রার মানের উপর কোন দেশের সরকারের হস্তক্ষেপ করার ক্ষমতা নেই। তাই পৃথিবীর অনেক দেশেই এ ডিজিটাল মুদ্রার উপর সে দেশের সরকারের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।

ক্রিপ্টোকারেন্সি হলো একটি ডিজিটাল বা ভার্চুয়াল মুদ্রা যা ধরাও যায়না ছোঁয়াও যায়না, ক্রিপ্টোকারেন্সি আধুনিক ব্লকচেইন প্রযুক্তির উপর ভিত্তি করে তৈরি। কিছু পরিচিত ক্রিপ্টোকারেন্সি হলো বিটকয়েন (Bitcoin), তবে এর পাশাপাশি আরও অনেক ধরনের ক্রিপ্টোকারেন্সি রয়েছে, যেমন ইথেরিয়াম(Ethereum), লাইটকয়েন (Litecoin), এবং রিপল (Ripple)।[]

উদাহরণ

সম্পাদনা

সাধারণভাবে আমরা যখন কারো কাছে টাকা পাঠাই, তখন ব্যাংকের সাহায্য নিই। আবার যদি ব্যাংক খোলা না থাকে মোবাইল ব্যাংকিং (গুগল পে, পেটিএম, ফোনপি, ফ্রিচার্জ, অ্যামাজন পে ইত্যাদি ) বা অনেক ক্ষেত্রে কুরিয়ার ও পোস্ট অফিসের মধ্য দিয়েও পাঠাই। এ প্রক্রিয়া সম্পন্নের জন্য সেবা মাশুল আদায় করে সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান।

কিন্তু গুপ্তমুদ্রাতে যেহেতু তৃতীয় পক্ষের কোনও প্রয়োজন হয় না, তাই এর কোন বাড়তি মাশুলও নেই। তবে সর্বনিম্ন মাশুল রয়েছে।

আরো সহজে বোঝাতে চাইলে বলা যায় অ্যাপ্লিকেশন ভিত্তিক কিছু সার্ভিসের কথা। অনেক সময় মোবাইলে মাই জিপি, মাই রবি বা ডিংটন, ক্যাম স্ক্যান ব্যবহার করা হয়। এগুলোর মাধ্যমে রিচার্জ করলে পয়েন্ট আসে পরে সেগুলো দিয়ে ডাটা কেনা যায়। আর বিজ্ঞাপন দেখেও পয়েন্ট পাওয়া যায়। পরে সেই পয়েন্ট ব্যবহার করে কথা বলা ও ক্লাউড স্পেস পাওয়া যায়।

গুপ্তমুদ্রার তালিকা

সম্পাদনা

সারা পৃথিবীতে প্রায় হাজারেরও উপরে গুপ্তমুদ্রা রয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে__ • বিটকয়েন • ইথেরিয়াম • লাইটকয়েন • রিপল • মোনেরো • ড্যাশ • বাইটকয়েন • ডোজকয়েন ইত্যাদি তবে এগুলোর মধ্যে বিটকয়েন সবার পূর্বসূরী ও সবচেয়ে পরিচিত। মূলত এর সফলতার কারণেই আরো প্রতিদ্বন্দ্বী গুপ্তমুদ্রার জন্ম হয়।[]

ইতিহাস

সম্পাদনা

১৯৮৩ সালে মার্কিন গুপ্তলিখনবিদ ডেভিড চৌম গুপ্তলৈখিক পদ্ধতিতে ডিজিটাল উপায়ে টাকা আদান প্রদানের বিষয়টি নিয়ে কাজ শুরু করেন। যার নাম দেন ই-ক্যাশ। ১৯৯৫ সালে, তিনি ডিজিক্যাশের মাধ্যমে এটি একটি গুপ্তলৈখিক ইলেকট্রনীয় (বৈদ্যুতিন) মূল্য পরিশোধ ব্যবস্থার একটি প্রাথমিক রূপ বাস্তবায়নের দিকে এগুতে থাকেন। পরবর্তীতে সফটওয়ারে নির্দিষ্ট গুপ্তায়িত চাবিগুলি প্রবেশের পর প্রাপক প্রেরণকারীর অর্থ পান। তবে এই অর্থ কোনও রাষ্ট্রে পরিচালিত মুদ্রার (টাকা, ডলার, পাউন্ড, দিনার) মত নয়। সম্পূর্ণ অস্তিত্বহীন পয়েন্ট।

তবে সাতোশি নাকামোতো (কোন ব্যক্তি বা গ্রুপ) সফলভাবে কেন্দ্রীয় সংস্থাবিহীন ডিজিটাল নকগদ অর্থে মূল্য পরিশোধ ব্যবস্থা চালু করেন, যা বিটকয়েন নামে পরিচিত।

পদ্ধতি

সম্পাদনা

গুপ্তমুদ্রা যেহেতু অস্তিত্বহীন মুদ্রা। পিয়ার টু পিয়ার ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রেরক থেকে সরাসরি প্রাপকের কাছে যায়। সেহেতু এর বিনিময় পদ্ধতিও আলাদা।

ওয়ালেট

সম্পাদনা

ওয়ালেট অনলাইন মানিব্যাগ। যা অনলাইন ও অফলাইন, এই দুই ধরনের হয়। এই ওয়ালেট থেকে প্রেরণকারী অর্থ পাঠাতে পারে। আর গ্রহণকারী নিজের ওয়ালেটে ভর্তে পারে। প্রতিটি ওয়ালেটের এক একটি নিদির্ষ্ট এনক্রিপ্টেড ঠিকানা থাকে।

একবার আপনি একটি বিটকয়েন ওয়ালেট বেছে নিলে, এটি সেট আপ করা এবং এটি সঠিকভাবে ব্যবহার করার প্রতি খেয়াল রাখতে হবে। স্ক্যাম এবং ফিশিং প্রচেষ্টা থেকে আপনার বিটকয়েন ওয়ালেট রক্ষা করার জন্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করাও গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ।[][]

ব্লকচেইন

সম্পাদনা

এক ঠিকানা থেকে অন্য ঠিকানায় ক্রিপ্টোকারেন্সি পাঠাতে তা এনক্রিপটেড লেজার বা উন্মুক্ত খতিয়ানে রেকর্ড হয়ে যায়। যাকে ব্লকচেইন বলে। এখানে জমা থাকা তথ্য পৃথিবী যে কোন স্থান থেকে দেখা সম্ভব।

২০১৯ সালে, এটি অনুমান করা হয় যে ব্লকচেইন প্রযুক্তিতে প্রায় $২.৯ বিলিয়ন বিনিয়োগ করা হয়েছিল, যা আগের বছরের তুলনায় ৮৯% বেশি।[]

ব্লকচেইনে লিপিবদ্ধ প্রতিটি লেনদেনের বৈধতা নির্ণয়করণকে বলা হয় খনন (মাইনিং)। আর এ কাজ যারা করেন তাদেরকে বলা হয় খননকারী (মাইনার)। ফলে কোনও ধরনের প্রতারণার সম্ভাবনা থাকে না। পরিচয় গোপন থাকে উভয় পক্ষেরই।

১ বিটকয়েন খনন করতে কতক্ষণ লাগে? একটি বিটকয়েন তৈরি করতে সাধারণত প্রায় ১০ মিনিট সময় লাগে, যদিও এটি শুধুমাত্র শক্তিশালী প্রসেসরের দ্বারাই সম্ভব। আপনি যে বিটকয়েন মাইনিং হার্ডওয়্যার ব্যবহার করেন তা নির্ধারণ করবে আপনি কত দ্রুত মাইনিং করতে পারবেন।[][]

বৈশিষ্ট্য

সম্পাদনা
  • লেনদেনের দ্রুততম প্রক্রিয়া।
  • প্রত্যেক ব্যবহারকারী তার ডিজিটাল মুদ্রা মালিক। অন্যকেউ তার মালিকানা নিতে পারবে না।
  • একজন ব্যবহারকারী কয়েকটি একাউন্ট খুলতে পারেন। এসবের জন্য নাম, ঠিকানা বা ব্যক্তিগত তথ্যের প্রয়োজন হয় না।
  • ব্লকচেইনে জমা থাকা লেনদেনের তথ্য পৃথিবীর যেকোন জায়গা থেকে দেখা যাওয়ায় দুর্ণীতির সুযোগ নেই।
  • এটি সম্পূর্ণ অফেরতযোগ্য। ভুল ঠিকানা থেকে আর ফেরত পাওয়া যায় না।

প্রচার

সম্পাদনা
 
বিট কয়েন এটিএম

২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ সালে রোবোকয়েনের প্রতিষ্ঠাতে যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম বিটকয়েনের এটিএম বুথ খোলেন। অস্টিন ও টেক্সাসেও এরকম একটি এটিএম বুথ আছে কিন্তু এর স্ক্যানার পাসপোর্ট ও ড্রাইভিং লাইসেন্স পড়তে পারে। সেপ্টেম্বর ২০১৭ পর্যন্ত সারা বিশ্বে ১৫৭৪টি বিটকয়েন এটিএম স্থাপন করা হয়। ৯.০৫% গড় খরচে তে দিনে গড়ে ৩টি করে বিটকয়েন এটিএম স্থাপিত হয়।

জনপ্রিয়তা

সম্পাদনা

বিশ্বের বহুদেশে অনলাইন বিকিকিনির জন্য গুপ্তমুদ্রা বেশ জনপ্রিয়। উইকিপিডিয়া, ওয়ার্ডপ্রেস, মাইক্রোসফটের মত প্রায় ৩০ হাজারের বেশি প্রতিষ্ঠান গুপ্তমুদ্রা গ্রহণ করে।

গুপ্তমুদ্রার মূল্য দিন দিন বেড়েই চলেছে। এত মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ার কারণ হিসেব বিশেষজ্ঞরা মনে করেন এটি খনন করার জন্য শক্তিশালী কম্পিউটার ও সার্ভার প্রয়োজন। রয়েছে বিদ্যুৎ খরচ।

এশিয়ায় প্রবেশ

সম্পাদনা

২০১৪ সালের ১৫ আগস্ট বাংলাদেশ এশিয়ার প্রথম দেশ হিসেবে বিট কয়েন ফাউন্ডেশনে যুক্ত হয়। বাংলাদেশ সরকার বিটকয়েনের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে।

অপব্যবহার

সম্পাদনা

গুপ্তমুদ্রা সংরক্ষণের জন্য কোন সংরক্ষণাগার নেই। তাই ব্যাকআপ না থাকলে কম্পিউটার ক্রাশের মাধ্যমে মুছে যেতে পারে তথ্য উপাত্ত। হ্যাকিং ও ম্যালওয়্যার আক্রমণের হুমকিও রয়েছে। রয়েছে ডিজিটাল অর্থ চুরির আশংকাও। ৩৪ বছরের ইতিহাসে এ পর্যন্ত ৪০টিরও বেশি চুরির শিকার হয়েছে বিটকয়েন।

আরও দেখুন

সম্পাদনা

তথ্যসূত্র

সম্পাদনা
  1.   |শিরোনাম= অনুপস্থিত বা খালি (সাহায্য);
  2. মাহমুদ চৌধুরী, ড. মেহেদি (২০১৮-০১-০৯)। "বিটকয়েন, ক্রিপ্টোকারেন্সি ও ব্লকচেইন"। বনিকবার্তা। [স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
  3. "The Best Bitcoin Wallets: Securely Storing Your Cryptocurrency"The Post W3B। ২০২৩-০১-১৮। ২০২৩-০২-০১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০২-০১ 
  4. "Cryptocurrency wallet"Wikipedia (ইংরেজি ভাষায়)। ২০২৩-০১-২৪। 
  5. "Blockchain"Wikipedia (ইংরেজি ভাষায়)। ২০২৩-০১-৩০। 
  6. "How to mine Bitcoin: A beginner's guide to mine BTC"Cointelegraph। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০২-০১ 
  7. Maheshwari, Rashi (২০২৩-০১-১৮)। "How Does Bitcoin Mining Work?"Forbes। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০২-০১