ক্রান্তীয় বলয়
ক্রান্তীয় বলয় (Tropics) হলো পৃথিবীর নিরক্ষীয় অঞ্চলকে ঘিরে উত্তর গোলার্ধে কর্কটক্রান্তি এবং দক্ষিণ গোলার্ধে মকরক্রান্তি অঞ্চল। ২৩°২৬′১১.৮″ (বা ২৩.৪৩৬৬°) উত্তর অক্ষাংশে কর্কটক্রান্তি ও ১৩′১৬′১১.৮″ (বা ২৩.৪৩৬৬°) দক্ষিণ অক্ষাংশে মকরক্রান্তি অবস্থিত। এই অক্ষাংশগুলো পৃথিবীর আক্ষিক আনতির সাথে মিলে যায়। পৃথিবীর যে সমস্ত অঞ্চলে বছরে কমপক্ষে একবার সূর্য সরাসরি খাড়াভাবে অবস্থান করে সেসব অঞ্চল ক্রান্তীয় বলয়ের অন্তর্ভুক্ত। ক্রান্তীয় বলয়কে ক্রান্তীয় অঞ্চল, গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চল এবং টরিড অঞ্চল হিসাবেও অভিহিত করা হয়।
জলবায়ুর ক্ষেত্রে ক্রান্তীয় অঞ্চলে সূর্য অন্যান্য অঞ্চলের খাড়াভাবে আলো দেয় এবং এসব অঞ্চল তুলনামূলক উষ্ণ ও ভেজা। 'ক্রান্তীয়' শব্দটি কখনো ভৌগোলিক অঞ্চলের পরিবর্তে এধরনের জলবায়ু বোঝাতে ব্যবহৃত হয়। ক্রান্তীয় অঞ্চলে মরুভূমি এবং তুষার-আচ্ছাদিত পর্বতমালা রয়েছে, যা জলবায়ুগত দিক থেকে ক্রান্তীয় নয়। ক্রান্তীয় অঞ্চল পৃথিবীর অন্যান্য জলবায়ু অঞ্চলগুলো যেমন, মধ্যাক্ষাংশ এবং মেরু অঞ্চল থেকে পৃথক করা হয়।
ভূ-পৃষ্টের ৪০% অংশ[১] এবং পৃথিবীর মোট স্থলাভূমির ৩৬%[২] ক্রান্তীয় অঞ্চলের অন্তর্গত। ২০১৪ সালের মধ্যে ৪০% জনসংখ্যার বাসস্থান এই অঞ্চল ছিল এবং ধারণা করা হয় ২০৫০ সালের মধ্যে পৃথিবীর ৫০% মানুষ এই অঞ্চলে বাস করবে।[৩]
মৌসুম এবং জলবায়ু
সম্পাদনা'ক্রান্তীয়' দ্বারা প্রায়ই উষ্ণ ও আর্দ্র এবং সতেজ উদ্ভিদে ভরা ক্রান্তীয় বা গ্রীষ্মমণ্ডলীয় জলবায়ু বোঝানো হয়। অনেক ক্রান্তীয় অঞ্চলে শুকনো এবং ভেজা মৌসুম থাকে। ভেজা বা বর্ষা মৌসুম এক বা একাধিক মাস হয়ে থাকে। এসময়ে বছরের মোট বৃষ্টিপাতের অধিকাংশ বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে।[৪] ভেজা মৌসুমের অঞ্চল ক্রান্তীয় এনং উপক্রান্তীয় অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত।[৫] কোপেন জলবায়ু শ্রেণিবিন্যাস অনুযায়ী, ক্রান্তীয় জলবায়ুগুলোতে, একটি ভেজা মৌসুমের মাসটিকে এমন এক মাস হিসাবে সংজ্ঞায়িত করা হয় যেখানে গড় বৃষ্টিপাত ৬০ মিলিমিটার (২.৪ ইঞ্চি) বা তারও বেশি হয়।[৬] ক্রান্তীয় অতিবৃষ্টি অরণ্য অঞ্চলে প্রকৃতপক্ষে কোন শুকনো বা ভেজা মৌসুম থাকেনা, কারণ এসব অঞ্চলে সারা বছর সম পরিমান বৃষ্টিপাত হয়।[৭]
ভেজা মৌসম যখন গ্রীষ্মে সংগঠিত হয় তখন বৃষ্টিপাত প্রধানত বিকাল থেকে সন্ধ্যার মধ্যে হয়। আর্দ্র মৌসুম এমন সময় হয় যখন বাতাসের গুণগতমান উন্নত হয়, মিঠা পানির গুণগতমান উন্নত হয় এবং উদ্ভিদ উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়, ফলে দেরীতে শস্যের ফলন হয়। বন্যার ফলে নদীর তীরগুলো উপচে পড়ে এবং কিছু প্রাণী উচ্চতর জমিতে যেতে বাধ্য হয়। মাটির পুষ্টি কমে যায় এবং ক্ষয় বৃদ্ধি পায়। উচ্চ তাপমাত্রার বর্ষাকাল এমন অঞ্চলে ম্যালেরিয়ার প্রকোপ বেড়ে যায়। পশুদের অভিযোজন এবং বেঁচে থাকার কৌশল রয়েছে। আগের শুকনো মৌসুমের ফলে ভেজা মৌসুমে খাদ্য সংকট দেখা দেয়, কারণ শস্যগুলো তখনও পরিপক্ব হয় না।
তবে ক্রান্তীয় অঞ্চলে সবসময় ক্রান্তীয় জলবায়ু থাকেনা। কোপেন জলবায়ু শ্রেণিবিন্যাসে সাহারা মরুভূমি, আটাকামা মরুভূমি এবং অস্ট্রেলিয়ান আউটব্যাক সহ অন্যান্য শুষ্ক স্থানকে ভৌগোলিক ক্রান্তীয় অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এছাড়াও অ্যালপাইন তুন্দ্রা এবং তুষার-ঢাকা শৃঙ্গ যেমন, মাওনা কেয়া, কিলিমাঞ্জারো, অ্যান্ডিসের চিলি এবং পেরুর উত্তরতম অংশ ভৌগোলিক ক্রান্তীয় অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত।
বাস্তুতন্ত্র
সম্পাদনাক্রান্তীয় উদ্ভিদ ও প্রাণী হলো ক্রান্তীয় জলবায়ুর স্থানীয় প্রজাতি। ক্রান্তিয় বাস্তুতন্ত্রগুলো ক্রান্তীয় অতিবৃষ্টি অরণ্য, মৌসুমী ক্রান্তীয় বন, শুকনো বন, মরুভূমি এবং অন্যান্য ধরনের আবাসের সমন্বয়ে গঠিত হতে পারে। অতিবৃষ্টি অরণ্য এবং মৌসুমী বনে উল্লেখযোগ্য জীববৈচিত্র্য ও এন্ডিমিজম (এমন একটি বাস্তুসংস্থানীয় অবস্থা যেখানে দেশীয় প্রজাতিরা শুধু একটি নির্দিষ্ট স্থানেই বিদ্যমান) রয়েছে। জীববৈচিত্র্য ও এন্ডিমিজমের কিছু উদাহরণ হলো- পুয়ের্তো রিকোতে এল ইউনক ন্যাশনাল অরণ্য, কোস্টা রিকান এবং নিকারাগুয়ান রেইনফরেস্টস, দক্ষিণ আমেরিকার বেশ কয়েকটি দেশের অ্যামাজন রেইনফরেস্ট অঞ্চল, মাদাগাস্কার শুকনা বন, দক্ষিণ আফ্রিকার ওয়াটারবার্গ এবং পূর্ব মাদাগাস্কার রেইনফরেস্ট। প্রায়শই ক্রান্তীয় বনাঞ্চলের মাটি পুষ্টির পরিমাণ কম থাকে।
জীবভূগোলে প্যালিওট্রপিকস (আফ্রিকা, এশিয়া এবং অস্ট্রেলিয়া) এবং নিউট্রপিক্স (ক্যারিবিয়ান, মধ্য আমেরিকা এবং দক্ষিণ আমেরিকা) এ বিভক্ত করা হয়েছে। একসাথে, তারা কখনও কখনও প্যান্ট্রপিক বলা। জীবজগতের অঞ্চল বিন্যাসের ব্যবস্থায় কিছুটা ভিন্নতা আছে; নিউট্রোপিকাল রাজ্যে নিওট্রোপিকস এবং নাতিশীতোষ্ণ দক্ষিণ আমেরিকা উভয়ই রয়েছে এবং প্যালিওট্রপিকসে আফ্রোট্রোপিকাল, ইন্দোমালায়ান, ওশিয়ানিয়ান এবং গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অস্ট্রেলাসিয়ান রাজ্য অন্তর্ভুক্ত।
ক্রান্তীয়তা
সম্পাদনাক্রান্তীয়তা (ইংরেজিতে ট্রপিক্যালিটি) বলতে ক্রান্তীয় অঞ্চলের বাইরের লোকেরা এই অঞ্চলকে নিয়ে যা ধারণা রাখে, সমালোচনামূলক থেকে শুরু করে ফেটিশিজম মনোভাব তারা পোষণ করে। ১৯৪০ এর দশকের শেষদিকে যখন ফরাসী ভূগোলবিদ পিয়ের গৌড়ো লেস পেস ট্রপিক্যাক্স (ইংরেজিতে ট্রপিকাল ওয়ার্ল্ড) প্রকাশ করেছিলেন তখন ক্রান্তীয়তার ধারণাটি ভৌগোলিক আলোচনায় নতুন আগ্রহ অর্জন করে।[৮]
ট্রপিক্যালিটি-তে দুটি বিষয় রয়েছে। প্রথমটি হলো এই অঞ্চলগুলোকে সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্যবিশিষ্ট পৃথিবীর স্বর্গ মনে করা হয়।[৯] দ্বিতীয় ধারনাটি হলো এটি একটি বন্য প্রকৃতি। পুরাতন পশ্চিমা সাহিত্যে দ্বিতীয় ধারনাটি প্রথমটি থেকে বেশি আলোচিত।[৯]
পশ্চিমা বিশেষজ্ঞরা কেন ক্রান্তীয় অঞ্চল মানবসভ্যতার জন্য উত্তর গোলার্ধের ঠাণ্ডা অঞ্চলগুলো থেকে কম বাসযোগ্য ছিল তার কারণ বের করার চেষ্টা করেছেন। জলবায়ুর উপর ভিত্তি করে একটি জনপ্রিয় ব্যাখ্যা আছে। ক্রান্তীয় জঙ্গল ও অতিবৃষ্টি অরণ্য অঞ্চলগুলো উত্তর গোলার্ধের শুষ্ক ও ঠাণ্ডা আবহাওয়া থেকে বেশি উষ্ণ ও আর্দ্র। এই ধারনার কারণে অনেক বিশেষজ্ঞরা মনে করেন যে মানুষের প্রকৃতির উপর কম ক্ষমতার সাথে আর্দ্র উষ্ণ জলবায়ুর সম্পর্ক আছে যেমন, বন্য আমাজন রেইনফরেস্ট।[১০]
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ "How much land is in the tropics?"। God Plays Dice। ২০০৭-১২-০৪। সংগ্রহের তারিখ ২০১৭-০৬-২৬।
- ↑ "tropics"। National Geographic Encyclopedia। National Geographic Society। সংগ্রহের তারিখ ২০১৭-০৬-২৬।
- ↑ "Expanding tropics will play greater global role, report predicts"। Science Magazine। ২৯ জুন ২০১৪।
- ↑ Glossary of Meteorology (2009). Rainy season. ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ২০০৯-০২-১৫ তারিখে American Meteorological Society. Retrieved on 2008-12-27.
- ↑ Michael Pidwirny (2008). CHAPTER 9: Introduction to the Biosphere. PhysicalGeography.net. Retrieved on 2008-12-27.
- ↑ "Updated world Koppen-Geiger climate classification map" (পিডিএফ)।
- ↑ Elisabeth M. Benders-Hyde (2003). World Climates. Blue Planet Biomes. Retrieved on 2008-12-27.
- ↑ Arnold, David. "Illusory Riches: Representations of the Tropical World, 1840-1950", p. 6. Journal of Tropical Geography
- ↑ ক খ Arnold, David. "Illusory Riches: Representations of the Tropical World, 1840-1950", p. 7. Journal of Tropical Geography
- ↑ Arnold, David. "Illusory Riches: Representations of the Tropical World, 1840-1950", p. 13. Journal of Tropical Geography