কোরিয়াল শাড়ি পশ্চিমবঙ্গের একটি ঐতিহ্যবাহী হাতে বোনা শাড়ি। এটি পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদবীরভূম জেলায় উত্পাদিত হয়। এই তাঁতের শাড়ি লাল পাড়, কশার অভিনবত্ব, অলঙ্কারযুক্ত আঁচল এবং বুননে প্রাকৃতিক তন্তুর (তুঁত রেশম) ব্যবহারের জন্য বিখ্যাত। কোরিয়াল শাড়ি ২০২৪ খ্রিস্টাব্দে একটি নিবন্ধিত ভৌগোলিক নির্দেশক হিসাবে স্বীকৃতি অর্জন করে।[]

কোরিয়াল শাড়ি
উৎপত্তিস্থলমুর্শিদাবাদবীরভূম, পশ্চিমবঙ্গ
উপাদানতুত রেশম
সুতার কাউন্ট৯০-৯২
দৈর্ঘ্য৫.৫০–৬.৫০ মিটার
শৈলীবাংলার ঐতিহ্য
আঁচলসুন্দর সূক্ষ্ম নকশা দ্বারা অলংকৃত
পাড়সরল বা অতিরিক্ত পোড়েন বিশিষ্ট
ব্যবহারদৈনন্দিন এবং উত্সব
প্রস্তুতকারীমুর্শিদাবাদবীরভূম জেলা তাঁত শিল্পীরা
ভৌগোলিক নির্দেশক মর্যাদানিবন্ধিত
ফাইল নং৭০৪

কোরিয়াল শাড়ি ঐতিহ্যগতভাবে আদিম তাঁতে বয়ন করা হয়, এবং নকশা তৈরির জন্য জালা পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। তাঁতের মাকুটি হাতের সাহায্যে ‘টানা’ সুতার মধ্যদিয়ে ছুড়ে অতিক্রম করানো হয়। বয়নে ১০০ কাউন্ট রেশম সুতা ব্যবহার করা হয় এবং এছাড়াও প্রয়োজন অনুসারে জড়িও ব্যবহার হয়। শাড়িতে সরল বুননের পাড় অথবা অতিরিক্ত টানা সুতা সহ পাড়; আঁচলে ঐতিহ্যবাহী ফুল ও জ্যামিতিক নকশা থাকে, যেগুলি জালা পদ্ধতিতে তৈরি করা হয়। শাড়ির সমগ্র জমিনে বা শরীরে ‘বুটি’ নকশা থাকে, যা অতিরিক্ত ‘পোড়েন’ সুতা সহ জালা পদ্ধতি ব্যবহার করে তৈরি করা হয়। কোরিয়াল শাড়ির বিশেষত্ব হল এটি বয়নের পর একটি সাধারণ ঐতিহ্যবাহী ‘খই মাড়’ দেওয়া হয় এবং একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য শুকিয়ে নেওয়া হয়। সবশেষে শাড়ি ভাঁজ করা হয়।

২০২৪ খ্রিস্টাব্দের তথ্য অনুসারে, পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ ও বীরভূম জেলায় ১৪৬ জন তাঁতি কোরিয়াল শাড়ি বয়নের কাজে যুক্ত রয়েছে। ২০১৮-১৯ অর্থবর্ষে, কোরিয়াল শাড়ির বার্ষিক বিক্রয় ছিল ₹২.৪৫ কোটি।

বহু শতাব্দী ধরে মুর্শিদাবাদ ও মালদা জেলায় রেশম উৎপাদিত হচ্ছে, কোরিয়ালে স্থানীয় মালদা রেশম ও আমদানিকৃত রেশম ব্যবহার করা হয়। উপকরণসমূহ তাঁতিদের দ্বারা তৈরির করা হয় না, বরং তাঁরা স্থানীয় সরবরাহের দোকান থেকে কেনা সামগ্রী ব্যবহার করে, যার মধ্যে ঐতিহ্যগতভাবে ব্যবহৃত রেশম তুত পোকা থেকে সংগ্রহ করা হয়। এই শাড়ির জন্য সবচেয়ে সাধারণ উপকরণ রেশমের উৎস হল তুত গাছে পালনকৃত তুতপোকা, তুঁত পোকার গুটি থেকে চাষিরা রেশম সংগ্রহ করে। কিছু রেশম স্থানীয় ব্যবসায়ীদের দ্বারা মূলত দক্ষিণ ভারত থেকে আমদানি করা হয়।

অন্যান্য উপকরণের মধ্যে রয়েছে জড়ি ও রং। শাড়িতে সোনালী রং-এর জড়ি ব্যবহৃত হয় - যেগুলি মূলত কৃত্রিম সূতা। রেশম সূতা রঙ্গিন করতে প্রাকৃতিক রঞ্জক বস্তু ব্যবহৃত হয়।

শাড়ি তৈরি

সম্পাদনা
 
একজন তাঁতি কোরিয়াল শাড়ি বয়ন করছেন।

ঐতিহাসিকভাবে, সূতা প্রস্তুত থেকে শুরু করে শাড়ির চূড়ান্ত বয়ন পর্যন্ত বস্ত্র উৎপাদন প্রক্রিয়ার প্রতিটি ধাপ পরিচালনার জন্য তাঁতি পরিবাদের প্রায় সকলেই নিযুক্ত থাকে। তাঁতি তাঁর চোখে ও হাতে একটি অবিশ্বাস্য সৃজনশীল শক্তি বহন করে, যা ঐতিহ্যগতভাবে তাঁদের পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত প্রযুক্তিগত দক্ষতা এবং নকশা ও রঙ সম্পর্কিত জ্ঞানের মাধ্যমে প্রকাশ পায়।

সুতা প্রস্তুত

সম্পাদনা

কোরিয়াল শাড়িতে দুটি প্লাই টুইস্টেড ফিলামেন্ট তুঁত রেশম সুতা ব্যবহার করা হয়। রেশম সুতার মোচড় তাঁতিদের দ্বারা সম্পন্ন করা হয়। টানা সুতা প্রস্তুত করার জন্য সুতার ফেটি থেকে সুতার ববিনে ধারন করা হয়; এই কাজের জন্য কিছু তাঁতি ববিং উইন্ডিং মেশিন ব্যবহার করে আবার কেউ কেউ ঐতিহ্যবাহী চরকা ব্যবহার করে। উল্লম্ব বিভাগীয় ওয়ার্পিং মেশিন ব্যবহৃত করে এই ববিনগুলিতে ধারণকৃত টানা সুতাকে দড়ি আকারে প্রস্তুত করা হয়। ক্ষার দ্রবণে ফোটানোর পর শুষ্ক (যদি প্রয়োজন হয়) করা হয়। এর পরে সুতার জট খোলা হয়, এবং ভাঙা প্রান্তটি রাস্তায় দৈর্ঘ্য অনুসারে ছড়িয়ে দিয়ে মেরামত করা হয়। সবশেষে ভরনা সুতা একটি কাঠের তৈরির দণ্ডে বাঁধা হয়।

বাংলায় উৎপাদিত তুঁত রেশম সুতা কোড়িয়াল শাড়িতে ভরনা বা পোড়েন সুতা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এই রেশম সুতা থেকে কাঁচা রেশমের আঠা অপসারণ করা জন্য ৩০ মিনিটের কাছাকাছি সময় ধরে একটি সাবান দ্রবণযুক্ত ব্যাচে ফুটানো হয়। এই প্রক্রিয়ায় ৪ কেজি উপাদানের জন্য ৩০ লিটার জলে ৬০০ গ্রাম সাবান ও ৪০০ গ্রাম কস্টিক সোডা ব্যবহার করা হয়। এই প্রক্রিয়ার ফলস্বরূপ রেশম সুতা উজ্জ্বল, আকর্ষণীয় এবং রং করার জন্য উপযুক্ত হয়ে ওঠে। বাড়তি ভরনা বুটি তৈরির জন্য প্রথমে রেশমের সুতা ফেটি থেকে লাটাইতে স্থানান্তর করা হয় এবং তারপর প্রয়োজন অনুসারে দুই বা তিনটি সুতা পাকিয়ে একটি সুতায় পরিণত করা হয়। বুননের জন্য মাকুতে ব্যবহৃত পিরিনে সুতা ধারন করা হয়।

কোড়িয়াল শাড়ির তৈরির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হল বয়ন, কারণ কোড়িয়াল শাড়ির গুণমান এই ধাপের উপর নির্ভর করে। এই শাড়ি তৈরির ক্ষেত্রে বয়নে সবচেয়ে বেশি সময় ব্যয় হয়। একটি সাধারণ মানের শাড়ি বয়নে ন্যূনতম ৭ থেকে ৮ দিন প্রয়োজন হয়, কিন্তু নকশা অন্তর্ভুক্ত করা হলে ন্যূনতম ১০ থেকে ১২ দিন সময় প্রয়োজন হয়।

তাঁতিদের দ্বারা তাঁতের সঙ্গে পাটা দণ্ড সংযুক্ত করা হয়, এবং পাটা দণ্ডে বাঁধা পাটা সুতা বা টানা সুতা সারনা (মেইল ​​আই) এবং রিডের মধ্যে দিয়ে স্থাপন করা হয়। ভরনা সুতা ধারণকৃত পিরিন সহ মাকু দ্বারা শাড়ি বয়ন শুরু হয়। প্রধানত কোরিয়াল শাড়ি হস্তচালিত গর্ত তাঁতে বয়ন করা হয়। শাড়িতে পোড়েনের সুতা হাতের সাহায্যে টানা বা পাটা সুতার মধ্য দিয়ে বয়ন করা হয়। বয়নের জন্য তিনটি মাকুর ব্যবহার করা হয়। শাড়ির জমিন ও পাড় পৃথক পৃথক ভরনা বা পোড়েন সুতা দিয়ে বয়ন করা হয়। নকশার প্রয়োজন অনুযায়ী শাড়িতে অতিরিক্ত পোড়েন বা অতিরিক্ত টানা সুতা যুক্ত করা হয়। শাড়ি বয়নের সময়ে প্রয়োজন অনুসারে নকশা তৈরিই জন্য জালা ব্যবহার করা হয়।

মাড় প্রয়োগ

সম্পাদনা

বয়নের পর প্রতিটি শাড়িতে একটি বিশেষ মাড় প্রয়োগ হয়। মাড় তৈরির জন্য খই ব্যবহার করা হয়। খাইকে জলে ফুটিয়ে তারপর ঠান্ডা করার মাধ্যমে মাড় প্রস্তুত করা হয়। একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য এটি শাড়িতে প্রয়োগ করা হয় এবং যখন শাড়ি শুকিয়ে যায় তখন শাড়িটি ভাঁজ করা হয়।

যন্ত্রপাতি

সম্পাদনা
 
কোরিয়াল শাড়ির বয়নে ব্যবহৃত জালা ব্যবস্থা।

ঐতিহ্যগতভাবে কোরিয়াল শাড়ি তৈরির প্রধান যন্ত্রপাতিগুলি হল আদিম বা আদি তাঁত ও জালা ব্যবস্থা। আদিম বা আদি তাঁত হল পারম্ভিক সময়ের তাঁত; এই তাঁতে বস্ত্র বয়নের জন্য মাকুটিকে হাতের সাহায্যে ছুঁড়ে একপ্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে পেরন করা হয়, ফলে বয়নের জন্য অধিক সময়ের প্রয়োজন হয়। যে কারনে কোরিয়াল শাড়ি বয়নে অনেক বেশি সময়ের প্রয়োজন হয়।

হস্তচালিত তাঁতে জালা ব্যবস্থা খুবই আদিম প্রক্রিয়া, এই ব্যবস্থার ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে কোরিয়াল শাড়ি বয়নে। জালা দেখতে অনেকটা হুকের মতো একটি কাঠামো। এই ব্যবস্থা শাড়িতে প্রধানত বুটি নকশা তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। জালা প্রক্রিয়ায় শাড়ির পছন্দসই এলাকা অনুযায়ী নকশা অন্তর্ভুক্ত করতে পারে। যখন শাড়িতে নকশা অন্তর্ভুক্ত করা হয়, তখন জালা নির্দিষ্ট অবস্থানে সন্নিবেশ করানো হয়।

তথ্যসূত্র

সম্পাদনা
  1. "Application details of the Korial Saree - Geographical Indications"। Intellectual Property India। সংগ্রহের তারিখ ৩০ জানুয়ারি ২০২৪