কোডেক্স জিগাস (লাতিন: Codex Gigas; বাংলা: দৈত্যাকার গ্রন্থ) হল বিশ্বের বৃহত্তম অদ্যাপি বিদ্যমান মধ্যযুগীয় অলংকৃত পাণ্ডুলিপি। এটির দৈর্ঘ্য ৯২ সেমি (৩৬ ইঞ্চি)।[] এই পাণ্ডুলিপিটিতে প্রথাবিরুদ্ধভাবে শয়তানের একটি পূর্ণ-পৃষ্ঠা প্রতিকৃতি এবং তার সৃষ্টি-সংক্রান্ত কিংবদন্তিগুলির উল্লেখ থাকায়, এটি শয়তানের বাইবেল (ইংরেজি: Devil's Bible) নামেও পরিচিত।

কোডেক্স জিগাস; দিয়াবলের প্রতিকৃতি-সংবলিত পৃষ্ঠা

খ্রিস্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে বোহেমিয়ার বেনেডিকটাইন পোডলাজাইস মঠে (অঞ্চলটি বর্তমানে চেক প্রজাতন্ত্রের অন্তর্গত) এই পাণ্ডুলিপিটি লিখিত হয়েছিল। সমগ্র ভালগেট বাইবেল এবং সেই সঙ্গে অন্যান্য কয়েকটি জনপ্রিয় গ্রন্থ এই পাণ্ডুলিপির অন্তর্ভুক্ত। সব ক’টিই লাতিন ভাষায় রচিত। পুরাতন ও নূতন নিয়মের মধ্যে একটি অংশে অন্যান্য জনপ্রিয় মধ্যযুগীয় সহায়ক গ্রন্থগুলি অন্তর্ভুক্ত হয়েছে: জোসেফাসের ইহুদি পুরাতত্ত্বইহুদি যুদ্ধ, সেভিলের ইসিডোর রচিত বিশ্বকোষ এটিমোলোজিয়া, প্রাগের কসমাস রচিত ক্রনিকা,[] এবং চিকিৎসাশাস্ত্র-সংক্রান্ত গ্রন্থাবলি; এগুলি হল আর্স মেডিসিনা সনদ-সংকলনের একটি আদি পাঠ এবং কনস্টানটাইন দ্য আফ্রিকান রচিত দু’টি গ্রন্থ।[]

ঘটনাচক্রে পাণ্ডুলিপিটি স্থান পেয়েছিল প্রাগে দ্বিতীয় রুডলফের সাম্রাজ্যিক গ্রন্থাগারে। ১৬৪৮ সালে সুইডিশরা ত্রিশ বছরের যুদ্ধের লুণ্ঠিত দ্রব্য হিসাবে সমগ্র সংকলনটি স্বদেশে নিয়ে যায়। বর্তমানে পাণ্ডুলিপিটি সংরক্ষিত রয়েছে স্টকহোমে অবস্থিত সুইডেনের জাতীয় গ্রন্থাগারে। সেখানে এটি জনসাধারণের দর্শনার্থে প্রদর্শিত হয়।[]

অতিবৃহদাকার অলংকৃত বাইবেলসমূহ রোমানেস্ক মঠ গ্রন্থ প্রকাশনার একটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য।[] কিন্তু সেই ধরনের বইগুলির মধ্যেও কোডেক্স জিগাসের পৃষ্ঠার আকার ব্যতিক্রমী ধরনের।

বর্ণনা

সম্পাদনা
 
বাইবেলের একটি পুস্তকের সূচনায় অলংকৃত আদ্যক্ষর

কোডেক্সটির বাঁধাই চামড়ায় মোড়া এবং অলংকার-সমৃদ্ধ ধাতব পাতযুক্ত কাঠের বোর্ডে। এটির দৈর্ঘ্য ৯২ সেমি (৩৬ ইঞ্চি), প্রস্থ ৫০ সেমি (২০ ইঞ্চি) ও পুরুত্ব ২২ সেমি (৮.৭ ইঞ্চি)। এটিই জ্ঞাত মধ্যযুগীয় পাণ্ডুলিপিগুলির মধ্যে বৃহত্তম।[] ৭৪.৮ কেজি (১৬৫ পা) ওজনের এই কোডেক্স জিগাস ৩১০টি ভেলামের পাতা দিয়ে তৈরি। দাবি করা হয়েছে, এই ভেলামগুলি ১৬০টি গাধার চামড়া, বা সম্ভবত বাছুরের চামড়া দিয়ে তৈরি হয়েছিল। এগুলির সামগ্রিক ক্ষেত্রফল ১৪২.৬ মি (১,৫৩৫ ফু)।[] প্রথম দিকে এটিতে ৩২০টি পাতা ছিল। যদিও এগুলির কয়েকটি পরবর্তীকালে সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল।[] কে কী কারণে এই পাতাগুলি সরিয়েছিলেন তা জানা যায় না। তবে মনে করা হয়, সরানো পাতাগুলিতে বেনেডিকটাইনদের সন্ন্যাস-সংক্রান্ত নিয়মাবলি লিখিত ছিল।

পাণ্ডুলিপিটিতে লাল, নীল, হলুদ, সবুজ ও সোনালি রঙের অলংকরণ ব্যবহৃত হয়েছে। বাইবেলের পুস্তকগুলি এবং রাজাবলির সূচনায় বড়ো হাতের অক্ষরগুলি বিভিন্ন রঙে বিস্তারিতভাবে অলংকৃত। ক্ষেত্রবিশেষে সেগুলি এতটাই বড়ো যে সমগ্র পৃষ্ঠা জুড়ে অঙ্কিত। এগুলির মধ্যে ৫৭টি পাণ্ডুলিপিটির মধ্যে রয়ে গিয়েছে (আদিপুস্তকের সূচনাংশটি পাওয়া যায় না)। এছাড়া নীল রঙে ২০টি আদ্যক্ষর লাল রঙের লাল দ্রাক্ষালতার অলংকরণে চিত্রিত হয়েছে। দিয়াবলের প্রতিকৃতি, জোসেফাসের একটি লেখক প্রতিকৃতি এবং একটি আদ্যক্ষরের উপর একটি কাঠবিড়ালির ছবি (এফ. ১১০ভি) ছাড়া মানুষ বা পশুপাখির ছবির বদলে সকল অলংকরণেই জ্যামিতিক বা গাছপালার ছবি দেখা যায়।[] এগুলি ছাড়া আরও দু’টি ছবি এই পাণ্ডুলিপিতে পাওয়া যায়। এই দু’টি সৃষ্টির সময়কার স্বর্গ ও পৃথিবীর ছবি। এই ছবি দু’টিতে নীল ও সবুজ বৃত্তের আকারে যথাক্রমে সূর্য-চন্দ্র ও কয়েকটি তারা এবং একটি গ্রহ বোঝানো হয়েছে। গ্রহটিতে কোনও ভূখণ্ড নেই, পুরোটাই সমুদ্রে ঘেরা। বইটির মধ্যে অধিকাংশ বড়ো হাতের অক্ষরই অনেকটা বড়ো আকারে লিখিত হয়েছে। এগুলির উচ্চতা লেখার প্রায় পাঁচ থেকে ছয়টি পঙ্‌ক্তি অবধি উঠে গিয়েছে। এগুলি লাল কালিতে মার্জিন অংশে লিখিত। পদ্যা রচনাগুলির সূচনাংশের মতো অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ বিভাগগুলি সামান্য বড়ো আকারে মূল পাঠের মধ্যেই লিখিত। এই অক্ষরগুলির চারপাশে হলদেটে কালি দিয়ে উজ্জ্বল করা।[১০]

কোডেক্সটির একটি সমরূপতা দেখে অনুমান করা হয় লেখার প্রকৃতি প্রথম থেকে শেষাবধি অপরিবর্তিত রয়ে গিয়েছে। এর থেকে সাধারণভাবে লোকের মনে একটি বিশ্বাস জন্মেছে যে, সমগ্র বইটি অত্যন্ত কম সময়ের মধ্যে লিখিত (কিংবদন্তি দেখুন)। তবে গবেষকেরা অপর একটি তত্ত্ব বিশ্লেষণের কাজ শুরু করেছেন। এই তত্ত্ব মতে গ্রন্থটি সম্পূর্ণ হতে ২০ বছরেরও বেশি সময় লাগে।[১১]

এই কোডেক্সটির দৈর্ঘ্য, আকার ও বিবরণ এতটাই অস্বাভাবিক রকমের বিশাল যে, এটির উৎস নিয়ে একটি কিংবদন্তি প্রচারিত হয়। এই কিংবদন্তি অনুযায়ী, একজন মাত্র লিপিকর এক রাত্রের মধ্যে স্বয়ং দিয়াবলের সাহায্যে এই গ্রন্থ রচনা সমাপ্ত করেছিলেন।[১২][১৩]

পৌরাণিক কাহিনী

সম্পাদনা
 
২৯০ পৃষ্ঠার শয়তানের চিত্র।

একটি পৌরাণিক কাহিনীর অনুযায়ী যা মধ্যযুগে নথিভুক্ত করা হয়েছিল : এই পাণ্ডুলিপির লেখক ছিলেন একজন মোনাকো, যে তার মোনাকোর প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করে যার ফলে তাকে শাস্তি হিসেবে তাকে জীবিত দেওয়াল গেঁথে বুজিয়ে দেওয়া হয়। এই কঠোর শাস্তি থেকে নিবৃত্তি পাওয়ার জন্য তিনি প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করেন যে তিনি এক রাতের মাঝে একটি বই তৈরি করবেন যা তার আশ্রমের নাম চিরকালের জন্য সুখ্যাতি করবে, যেখানে মানুষের সমস্ত জ্ঞান থাকবে। তিনি মধ্যরাত্রি কাছাকাছি নিশ্চিত হন, যে তিনি একা এই কাজের সম্পূর্ণ করতে পারবেন না, তাই তিনি একটি বিশেষ প্রার্থনা করেন, ঈশ্বরের কাছে না নিপতিত দেবদূত শয়তানের কাছে। তার আত্মার বিনিময়ে বইটি সম্পূর্ণ করার সাহায্য প্রার্থনা করেন। শয়তান পাণ্ডুলিপিটি সম্পূর্ণ করে এবং মোনাকো শয়তানের সাহায্যের কৃতজ্ঞতা জানানোর জন্য প্রতীক হিসেবে সে একটি চিত্র সংযোগ করেন।[][১৪][১৫]

আরও দেখুন

সম্পাদনা

তথ্যসূত্র

সম্পাদনা
উল্লেখপঞ্জি
  1. "Codex Gigas"The National Library of Sweden। ১২ অক্টোবর ২০০৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৬-০২-১৩ 
  2. "About the Content"The National Library of Sweden 
  3. "Medical contents"The National Library of Sweden 
  4. "The Treasury Room – Codex Gigas exhibition"The National Library of Sweden 
  5. Cahn, Walter, Romanesque Bible Illumination, Ithaca, New York: Cornell University Press, 1982, আইএসবিএন ০৮০১৪১৪৪৬৬
  6. Boldan এবং অন্যান্য 2007, পৃ. 15।
  7. "Description of the MS"The National Library of Sweden। ২০০৭-০৬-১৯। সংগ্রহের তারিখ ২০১৩-১১-১৯ 
  8. Boldan এবং অন্যান্য 2007, পৃ. 17।
  9. "Selected Initials"The National Library of Sweden 
  10. "Decoration"The National Library of Sweden 
  11. "Devil's Bible"। ২০১১-০৯-০৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। 
  12. Gullick, M. (২০০৭)। "The Codex Gigas. A revised version of the George Svensson lecture delivered at the National Library of Sweden, Stockholm, November 2006"। Biblis 28: 5–19। 
  13. Braun, David Maxwell। "Devil's Bible Darkest Secrets Explained – National Geographic Society (blogs)"voices.nationalgeographic.org (ইংরেজি ভাষায়)। ২০১৭-১০-০৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৭-১০-০৭ 
  14. KB Legends
  15. "Satanic Inspiration", The Prague Post Online[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ], September 12, 2007.
গ্রন্থপঞ্জি
  • Boldan, Kamil; Dragoun, Michal; Foltýn, Duan; Marek, Jindřich; Uhlíř, Zdeněk (২০০৭)। The Devil's Bible – Codex Gigas: The Secrets of the World's Largest Book। NKP। আইএসবিএন 978-80-7050-532-8 

আরও পড়ুন

সম্পাদনা
  • Bártl, S., Kostelecký, J.: Ďáblova bible. Tajemství největší knihy světa, Paseka, 1993. আইএসবিএন ৮০-৮৫১৯২-৬৪-০
  • J. Belsheim, Die Apostelgeschichte und die Offenbarung Johannis in einer alten lateinischen Übersetzung aus dem 'Gigas librorum' auf der königlichen Bibliothek zu Stockholm (Christiana, 1879).

বহিঃসংযোগ

সম্পাদনা