কৃষ্ণোপনিষদ্‌ (সংস্কৃত: कृष्ण उपनिषत्) হল হিন্দুধর্মের ১০৮টি উপনিষদের অন্যতম। এটি একটি অপ্রধান উপনিষদ্‌। এই উপনিষদ্‌টি হিন্দু দেবতা কৃষ্ণের প্রতি উৎসর্গিত। অথর্ববেদের সঙ্গে যুক্ত[] কৃষ্ণোপনিষদ্‌ হল একটি বৈষ্ণব উপনিষদ্‌।[]

কৃষ্ণ
দেবনাগরীकृष्ण
IASTKṛṣṇa
নামের অর্থহিন্দু দেবতা কৃষ্ণের নাম
উপনিষদের
ধরন
বৈষ্ণব[]
সম্পর্কিত বেদঅথর্ববেদ[]
অধ্যায়ের সংখ্যা[]

এই উপনিষদ্‌টি একটি প্রতীকী পুরাণ। এই উপনিষদে বর্ণিত হয়েছে, কীভাবে বিষ্ণুর অবতার রাম কৃষ্ণ রূপে জন্মগ্রহণ করেন এবং কীভাবে বিভিন্ন দেবদেবী ও গুণাবলি কৃষ্ণের জীবনে ব্যক্তি বা বস্তুর রূপ ধারণ করে।

ইতিহাস

সম্পাদনা

কৃষ্ণোপনিষদ্‌ গ্রন্থটির রচনাকাল অজ্ঞাত। সম্ভবত এটি মধ্যযুগে রচিত হয়েছিল।[] "কৃষ্ণোপনিষদ্" ও "কৃষ্ণ উপনিষদ্" উভয় শিরোনামেই এই গ্রন্থটির পুথি পাওয়া গিয়েছে।[][] তেলুগু ভাষায় মুক্তিকোপনিষদ্‌ গ্রন্থে তাতে রাম কর্তৃক হনুমানের কাছে বর্ণিত ১০৮টি উপনিষদের তালিকা এই উপনিষদ্‌টির ক্রম ৯৬তম।[]

কৃষ্ণোপনিষদ্‌ দুই খণ্ডে বিভক্ত।[] প্রথম খণ্ডটি কাব্যে এবং দ্বিতীয় খণ্ডটি গদ্যে রচিত।[] যদিও কৃষ্ণোপনিষদ্‌ গ্রন্থের কোনও কোনও পুথিতে দ্বিতীয় খণ্ডটি পাওয়া যায় না।[]

বিষয়বস্তু

সম্পাদনা

প্রথম খণ্ড

সম্পাদনা

কৃষ্ণোপনিষদ্‌ গ্রন্থের শুরুতে দেখা যায়, ঋষিরা বনে বিষ্ণুর ৭ম অবতার রামের সঙ্গে দেখা করতে আসলেন। রামকে দেখে মুগ্ধ হয়ে তারা তাকে আলিঙ্গন করতে চাইলেন।[] রাম তাদের উপদেশ দিলেন দিব্য প্রেমের এহেন অভিপ্রকাশের জন্য কিছুকাল অপেক্ষা করতে। রাম বললেন, ঋষিরা যদি যোগবলে নারীদেহও ধারণ করেন, তবু তিনি তাদের আলিঙ্গন করতে পারবেন না। কারণ, তিনি তার পত্নী সীতার প্রতি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।[][] তিনি আরও বললেন যে, তিনি কৃষ্ণ রূপে অবতার গ্রহণ করবেন এবং ঋষিরা গোপী (গোয়ালিনী) রূপে পুনরায় জন্মগ্রহণ করবেন। তখনই তারা তাকে আলিঙ্গন করতে পারবেন।[][১০] রামের এই কথা শুনে ঋষিরা আনন্দিত হলেন।[১১]

 
গোপীসঙ্গে কৃষ্ণ। জলরং, ১৮শ শতাব্দী।

এরপর এই উপনিষদে কৃষ্ণ অবতার ও তার জীবনের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। স্বর্গকে বর্ণনা করা হয়েছে কৃষ্ণের বাল্যলীলাস্থল গোকুল রূপে। বিষ্ণু গোপ (রাখাল) রূপে কৃষ্ণ অবতার গ্রহণ করলেন। এই গ্রন্থে বলা হয়েছে, তার রাখাল সখারা হলেন স্বর্গের দেবতা। তার পালক পিতামাতা নন্দ হলেন আনন্দ ও যশোদা হলেন মোক্ষ[১২] যাঁরা তপস্যা করেছেন, তারা গোকুলে বৃক্ষ রূপে জন্মগ্রহণ করেন। প্রণব বা ওঁ কৃষ্ণের মাতা দেবকী এবং বেদের নিগম কৃষ্ণের পিতা বসুদেব রূপে জন্মগ্রহণ করেন।[১৩] বেদের স্তোত্রগুলি গাভীর রূপ ধারণ করে।[১৩][১০] উপনিষদের শ্লোকগুলি ১৬,১০৮ গোপিনীর রূপ ধারণ করে ব্রহ্ম রূপী কৃষ্ণের প্রতি আকৃষ্ট হন এবং তারা প্রত্যেকে হন ঋগ্বৈদিক স্তোত্রে বর্ণিত পরব্রহ্ম।[১৪][১০]

দয়া তার ‘মা’ রোহিণী, ভুদেবী তার পত্নী সত্যভামা হন। শান্তি হন তার সখা সুদাম[১৫] ক্রোধ, লোভ ও পাপেরা অসুর হয়।[১০][১৫] ‘দম’ (আত্মসংযম), সত্য ও দুগ্ধসমুদ্র হন যথাক্রমে উদ্ধব, অক্রুর এবং কৃষ্ণের খেলাচ্ছলে ভাঙা ননীর পাত্র।[১৬] ঋষি কশ্যপ ও দেবজননী অদিতি হন সেই দণ্ড ও রজ্জু দেগুলির সঙ্গে দুষ্টু কৃষ্ণকে বেঁধে রাখা হত। শিব, কালীমায়া হন যথাক্রমে কৃষ্ণের অস্ত্র তরবারি, গদাধনুক[১৭] তার হাতের পদ্মটি ছিলেন ব্রহ্মাণ্ডের উৎসব। কৃষিকার্যের ঋতু শরৎ তার খাদ্য। বিষ্ণুর বাসস্থান বৈকুণ্ঠ পৃথিবীতে পুনঃসৃজিত হয়।[১৮][১৯]

দ্বিতীয় খণ্ড

সম্পাদনা

কৃষ্ণোপনিষদ্‌ গ্রন্থের দ্বিতীয় খণ্ডে একটি প্রতীকী পুরাণকথা বর্ণিত হয়েছে। এই পুরাণকথার উপজীব্য বিষয় কীভাবে জীব ও গুণাবলি ব্রহ্মাণ্ডে আবির্ভূত হয়েছে।[২০][২১] এই গ্রন্থ অনুসারে, বিষ্ণু হলেন সর্বোচ্চ সত্য। তিনি ‘সঙ্কর্ষণ’ নাম ধারণ করে এক জীব হিসেবে প্রথম জন্মগ্রহণ করেন। তার ইচ্ছা ছিল সন্তানের জন্মদান। প্রথমে তিনি প্রেমের দেবতা প্রদ্যুম্নের জন্ম দেন। প্রদ্যুম্ন অনিরুদ্ধ (মুক্তি), অহংকার ও হিরণ্যগর্ভের জন্ম দেন।[২০] হিরণ্যগর্ভ জন্ম দেন প্রজাপতিগণ, মারিচী, বায়ু, স্থাণু, দক্ষ, কর্দম, প্রিয়ব্রত ও উত্তানপাদের। এঁরাই ব্রহ্মাণ্ডে সকল প্রাণীর জন্মদাতা।[২০][২১]

এই গ্রন্থ অনুসারে, বিষ্ণুর শেষনাগের অংশগুলি হল সকল বস্তু ও প্রাণ এবং জ্ঞান এবং জ্ঞানের জ্ঞান।[২০][২১] তিনি দক্ষতা ও ধর্ম[২০] ব্রহ্মাণ্ডের উৎস সংক্রান্ত এই বিষয়ের ধ্যান করলে, বিষ্ণুর সর্বোচ্চ সত্ত্বার ধ্যান করলে এবং তার নাম ও গুণাবলি বারংবার জপ করলে মুক্তিলাভ করা যায়।[২০][২১]

দেবদেবীরা কৃষ্ণের সাহচর্য পাওয়ার জন্য মর্ত্যে আবির্ভূত হয়েছিলেন। তার কৃষ্ণপ্রেমের মাধ্যমে আনন্দ লাভ করেছিলেন।[২২] কৃষ্ণোপনিষদ্‌ ভক্তিযোগের কথা প্রচার করে। এই উপনিষদের মধ্যে ঈশ্বরের প্রতি প্রেম ও ভক্তির মাধ্যমে মুক্তিলাভ সম্ভব।[২৩] এই উপনিষদ্‌টি সম্ভবত কৃষ্ণধর্ম থেকে উৎসারিত। উল্লেখ্য, কৃষ্ণধর্মে কৃষ্ণকে বিষ্ণুর অবতারমাত্র মনে করা হয় না। বরং এই ধর্মে কৃষ্ণ হলেন বিষ্ণু ও বিষ্ণুর অন্যান্য অবতারের উৎস। কৃষ্ণ হলেন স্বয়ং ভগবান এবং বিষ্ণুর ঊর্ধ্বে তার স্থান।[২৪]

বৈষ্ণব দার্শনিক বল্লভাচার্য এই উপনিষদের টীকায় লিখেছেন যে, গোপ ও গোপীরা হলেন কৃষ্ণের সখা ও সখী। সেখানকার লোভী ব্যক্তিরা হলেন অসুর। তিনি আরও লিখেছেন যে, অজ্ঞানতার পাঁচটি রূপের প্রতীক পাঁচ দুষ্ট ব্যক্তি। তাদের কৃষ্ণ ধ্বংস করেন।[২৫]

তথ্যসূত্র

সম্পাদনা
  1. Tinoco 1996, পৃ. 88।
  2. Raghunandan 1996
  3. Ayyangar 1941, পৃ. 22-31।
  4. Studia Orientalia85। Finnish Oriental Society, Suomen Itämainen Seura। ১৯৯৯। পৃষ্ঠা 356–357। 
  5. Vedic Literature, Volume 1, গুগল বইয়ে A Descriptive Catalogue of the Sanskrit Manuscripts, পৃ. PA338,, Government of Tamil Nadu, Madras, India, pages 338-339
  6. Deussen 1997, পৃ. 556-557।
  7. Ayyangar 1941, পৃ. 31।
  8. Ayyangar 1941, পৃ. 22-23।
  9. Alain Daniélou (১ ডিসেম্বর ১৯৯১)। The Myths and Gods of India: The Classic Work on Hindu Polytheism from the Princeton Bollingen Series। Inner Traditions / Bear & Co। পৃষ্ঠা 176আইএসবিএন 978-0-89281-354-4 
  10. Raghunandan 1996, পৃ. 1-2।
  11. Ayyangar 1941, পৃ. 23।
  12. Ayyangar 1941, পৃ. 24-25।
  13. Ayyangar 1941, পৃ. 25।
  14. Ayyangar 1941, পৃ. 26।
  15. Ayyangar 1941, পৃ. 25-27।
  16. Ayyangar 1941, পৃ. 26-27।
  17. Ayyangar 1941, পৃ. 27-28।
  18. P. R. Ramachander। "Krishna Upanishad"। Vedanta Spiritual Library। ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৮ জানুয়ারি ২০১৫ 
  19. A Study of the Bhagavata Purana। Madras Theosophical Publishing House। ১৯৫০। পৃষ্ঠা 449। 
  20. Ayyangar 1941, পৃ. 29-31।
  21. Raghunandan 1996, পৃ. 3-4।
  22. Stephen Knapp (২০০৫)। The Heart of Hinduism: The Eastern Path to Freedom, Empowerment and Illumination। iUniverse। পৃষ্ঠা 16। আইএসবিএন 978-0-595-35075-9 
  23. Ernest Wood (১ অক্টোবর ২০০৭)। The Ten Original Systems of Yoga। Indo-European Publishing। পৃষ্ঠা 98। আইএসবিএন 978-1-60444-009-6 
  24. Nagendra Kumar Singh (১৯৯৯)। Encyclopaedia of Hinduism। Centre for International Religious Studies : Anmol Publications। পৃষ্ঠা 29। আইএসবিএন 978-81-7488-168-7 
  25. Vallabhācārya (২০০৩)। Collected Works of Shri Vallabhachārya: chapt. 12–17। Sri Satguru Publications। পৃষ্ঠা 1637। আইএসবিএন 978-81-7030-788-4 

গ্রন্থপঞ্জি

সম্পাদনা

বহিঃসংযোগ

সম্পাদনা