কীর্তিনারায়ণ বসু

চন্দ্রদ্বীপের রাজা

কীর্তিনারায়ণ বসু, অথবা কীর্তি নারায়ণ বসু, ছিলেন বৃহত্তর বরিশালের মধ্যযুগীয় চন্দ্রদ্বীপ রাজ্যের পঞ্চম রাজা[] তিনি নও-মুসলিম হয়ে কেওড়ার বাকলাই তালুকদার খান্দানের প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে উল্লেখযোগ্যও আছেন।

কীর্তিনারায়ণ বসু
চন্দ্রদ্বীপের রাজা
রাজত্ব১৬৬৮-?
পূর্বসূরিরামচন্দ্র বসু
উত্তরসূরিবাসুদেব বসু (চন্দ্রদ্বীপের রাজা হিসাবে)
মাহমূদ হাসন তক্কী (কেওড়ার তালুকদার হিসাবে)
জন্মমাধবপাশা রাজবাড়ী, চন্দ্রদ্বীপ
মৃত্যুপিপলিতা, চন্দ্রদ্বীপ (বর্তমান ঝালকাঠি জেলা, বাংলাদেশ)
বংশধরমাহমূদ হাসন তক্কী
ধর্মহিন্দুধর্ম (জন্মগত)
ইসলাম (গ্রহণগত)

পটভূমি

সম্পাদনা

কীর্তিনারায়ণ বসু সপ্তদশ শতকে বাঙালি কায়স্থ পরিবারে চন্দ্রদ্বীপের মাধবপাশা রাজবাড়ীতে জন্মগ্রহণ করেন। চন্দ্রদ্বীপ রাজ্য তখন মোগলদের সামন্ত রাজ্য বা জমিদারী ছিল কারণ ১৬১১ খ্রীষ্টাব্দে বাংলার মোগল সুবাহদার ইসলাম খাঁ কীর্তিনারায়ণের পিতা রাজা রামচন্দ্র বসুকে পরাজ​য় করেন। কিন্তু জমিদার হিসাবে থাকতে দেন এবং রাজা খেতাব রাখবার অনুমতিও দেন।[][] কীর্তিনারায়ণের মাতা বিমলা ছিলেন রামচন্দ্র বসুর প্রথম স্ত্রী এবং যশোরের রাজা প্রতাপাদিত্যের কন্যা।​[][]

রাজত্ত্ব

সম্পাদনা

পিতা রামচন্দ্রের মৃত্যুর পরে কীর্তিনারায়ণ চন্দ্রদ্বীপের রাজা হন।[] সিংহাসন আরোহন করেই চন্দ্রদ্বীপের পর্তুগিজ সেনাপতি, জন গেরি ১০ হাজার সৈন্য নিয়ে বিদ্রোহ আরম্ভ করেন।[] কীর্তিনারায়ণ চন্দ্রদ্বীপ ফৌজের অবশিষ্টাংশ সৈন্যদের সমাবেশ করে বর্তমান মেহেন্দিগঞ্জের বল্লভপুর গ্রামে ত্রিদিবসব্যাপী যুদ্ধে মশগুল হন।[] চন্দ্রদ্বীপের অনেক পর্তুগিজ সন্যরা মারা যায় এযুদ্ধে এবং সাবেক সেনাপতি জন গেরী বাকলা অঞ্চল পালিয়ে যায়।[]

পর্তুগিজ গাদ্দারীর কারণে কীর্তিনারায়ণ চন্দ্রদ্বীপ ফৌজ পুনর্গঠন করে এবং বাংলার মোগল সুবাহদার শায়েস্তা খাঁকে বঙ্গোপসাগরস্থ মগ​-পর্তুগিজ দমনাভিযানে সমর্থনের ঘোষণা করে।[১০] মগ​-পর্তুগিজ আক্রমণ থেকে চন্দ্রদ্বীপকে রক্ষা করতে কীর্তিনারায়ণ কয়েক কেল্লা নির্মাণ করেন।[১১] কালিজিরা নদী দুই পার্শ্বে কেল্লা গড়ে তুলেন; পূর্ব পার্শ্বের জাগুয়া গ্রামে নতুন একটি কেল্লা এবং পশ্চিম পার্শ্বের পিতা কর্তৃক নির্মিত রায়পুর গ্রামে কেল্লা সংস্কার করেন। কোটেরদোনেও একটি মাটির গড়খাই গড়িয়ে সৈন্যদল রাখেন, এবং শাহবাজপুরে কয়েক কেল্লা নির্মাণ করেন।[১২]

বাকলা অঞ্চলে শিক্ষাপ্রগতির ক্ষেত্রেও কীর্তিনারায়ণের অবদান রয়েছে কারণ তিনি মাধবপাশা, গুঠিয়া, হোসেনপুর, নারায়ণপুর, খালিসাকোঠা, শিকারপুর, নলচিড়া, গৈলা ইত্যাদি এলাকায় বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।[১২]

ইসলাম গ্রহণ

সম্পাদনা

কীর্তিনারায়ণের সামরিক ও শিক্ষাগত অবদান থেকেও তিনি নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার শিকার হন।[১৩] মগ​-পর্তুগিজ জলদস্যুদের সম্বন্ধে বাংলার সুবাহদার শায়েস্তা খাঁ কীর্তিনারায়ণকে আলোচনা সভায় আসবার অনুরোধ করেন। জাহাঙ্গীরনগর (পুরান ঢাকা) দরবারে এসে কীর্তিনারায়ণের সামনে একটি বিরাট জেয়াফত বসানো হয়। দস্তরখানের মধ্যে অবশ্যই হালাল গোশত ছিল। কীর্তিনারায়ণ এই জেয়াফতে হাজির হওয়ায় হিন্দু সমাজ তাঁকে ধর্মচ্যুত করে।[১৪] শায়েস্তা খাঁর দাওয়াত পরামর্শে, কীর্তিনারায়ণ স্বেচ্ছায় ইসলাম গ্রহণ করে এবং সম্ভবত মাহমূদ নাম নেন। চন্দ্রদ্বীপের হিন্দু প্রবীণরা কোন মুসলমানকে রাজা হিসাবে মানতে না পেরে চন্দ্রদ্বীপের জমিদারী কীর্তিনারায়ণের ছোট ভাই বাসুদেবের কাছে দেওয়া হয়।[১২][১৫]

কীর্তিনারায়ণ তারপর কেওড়া গাঁওয়ে হেজর​ৎ করেন। সেখানে আবাদ হয়ে একজন মুসলিমাকে শাদী করেন। সেই হালাল মিলনের ফলে তাঁদের একটি ওলদ পয়দা হয় যার নাম দেওয়া হয় মাহমূদ হাসন তক্কী। মোগলদের সাথে কীর্তিনারায়ণ সম্পর্ক রাখেন এবং তাঁদের অধীনে মগ জলদস্যুদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে থাকেন। এক মোকাবেলায় আহত হয়ে কেওড়ার দিকে পিছু হটেন। তিনি শীঘ্রই ইন্তেকাল করেন এবং নিকটবর্তী পিপিলিতা গাঁওয়ে তাঁকে দাফন করা হয়। তাঁর কবরের পাশে তাঁর প্রিয় ঘোড়াকেও দাফন করা হয়।[১৬]

ওয়ারিশ

সম্পাদনা

যদিও তিনি চন্দ্রদ্বীপ ছাড়তে বাধ্য হন, তিনি চন্দ্রদ্বীপ ও সেলিমাবাদ পরগনাদ্বয়ে অনেক জমীন রাখতে পেরেছিলেন। তাঁর আওলাদ কেওড়ার বাকলাই খান্দান হিসাবে মশহূর এবং মঠবাড়িয়ামোড়েলগঞ্জ এলাকায় তাঁদের তালুক ছিল।[১৭] তাঁর ওলদ, মাহমূদ হাসন তক্কী, কেওড়া গাঁওয়ে মসজিদ তামীর করেছিলেন। তক্কী সাহেবের তিন ওলদ ছিল যাদের নাম মাহমূদ গজনফর আলী, মাহমূদ সাদেক এবং এজাজ মাহমূদ। মাহমূদ সাদেক ছিলেন কুতুব মাহমূদ সাহেবের বাবা, যিনি ছিলেন জান মাহমূদ সাহেবের বাবা, যিনি ছিলেন রহমত আলী বাকলাই সাহেবের বাবা, যিনি ছিলেন মাহমূদ আলী বাকলাই সাহেবের বাবা, যিনি ছিলেন আমূদ আলী বাকলাই সাহেবের বাবা, যিনি ছিলেন আহমদ আলী বাকলাই সাহেবের বাবা, যিনি ছিলেন আব্দুল মজীদ বাকলাই সাহেবের বাবা। রাজা কীর্তিনারায়ণ বসুর আওলাদের সংখ্যা মোট এক হাজারের বেশী।[১৬]

আরও দেখুন

সম্পাদনা
পূর্বসূরী
রামচন্দ্র বসু
চন্দ্রদ্বীপের রাজা
১৬৬৮-?
উত্তরসূরী
বাসুদেব বসু

তথ্যসূত্র

সম্পাদনা
  1. দেলওয়ার হাসান (২০১২)। "মাধবপাশা জমিদার পরিবার"ইসলাম, সিরাজুল; মিয়া, সাজাহান; খানম, মাহফুজা; আহমেদ, সাব্বীর। বাংলাপিডিয়া: বাংলাদেশের জাতীয় বিশ্বকোষ (২য় সংস্করণ)। ঢাকা, বাংলাদেশ: বাংলাপিডিয়া ট্রাস্ট, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটিআইএসবিএন 9843205901ওএল 30677644Mওসিএলসি 883871743 
  2. মুহম্মদ ইসহাক, সম্পাদক (১৯৮২)। Bangladesh District Gazetteers: Patuakhali (ইংরেজি ভাষায়)। বাংলাদেশ সরকারি মুদ্রণালয়। পৃষ্ঠা ২৯-৩০। 
  3. অনিরুদ্ধ রায় (২০১৬)। "Bengal"। Towns and Cities of Medieval India: A Brief SurveyTaylor & Francis। পৃষ্ঠা ২১৯। আইএসবিএন 9781351997317 
  4. প্রিয়া নাথ জানা (১৯৭৫)। বঙ্গীয় জীবনীকোষ। মাতৃভাষা পরিষদ। পৃষ্ঠা ৮০। 
  5. বৃন্দাবন চন্দ্র পুততুন্ড (১৯৬৪)। চন্দ্রদ্বীপের ইতিহাস। অধ্যায়ন। পৃষ্ঠা ৪৪। 
  6. সিরাজ উদদীন আহমেদ (১৯৮০)। আগা বাকেরইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ। পৃষ্ঠা ২৪। 
  7. বরিশাল বিভাগ প্রতিষ্ঠা উপলক্ষে স্মারক সংকলন। বরিশাল বিভাগ কল্যাণ সমিতি। ১৯৯৩। পৃষ্ঠা ৫০। 
  8. আকসদুল আলম (২০১২)। "চন্দ্রদ্বীপ"ইসলাম, সিরাজুল; মিয়া, সাজাহান; খানম, মাহফুজা; আহমেদ, সাব্বীর। বাংলাপিডিয়া: বাংলাদেশের জাতীয় বিশ্বকোষ (২য় সংস্করণ)। ঢাকা, বাংলাদেশ: বাংলাপিডিয়া ট্রাস্ট, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটিআইএসবিএন 9843205901ওএল 30677644Mওসিএলসি 883871743 
  9. প্রফুল্ল চন্দ্র রায় (১৯৫৮)। Autobiography of a Bengali Chemist। পাশ্চাত্য কেতাব শর্কৎ। পৃষ্ঠা ২৮৬। 
  10. এএফএম আব্দুল জলীল (১৯৬৮)। সুন্দরবনের ইতিহাস। লিঙ্কম্যান পাবলিকেশন্স। পৃষ্ঠা ২৯০। 
  11. সতীশচন্দ্র মিত্র (১৯৬৩)। শিবশঙ্কর মিত্র, সম্পাদক। যশোহর-খুলনার ইতিহাস। দাসগুপ্ত। পৃষ্ঠা ৩২৪, ৩৩০। 
  12. আহমেদ (২০১০), p. Vol. 2, কীর্তি নারায়ণ (রাজা).
  13. রাধাকুমুদ মুখোপাধ্যায় (১৯১২)। A History of Indian Shipping (ইংরেজি ভাষায়)। পৃষ্ঠা ২১৭–২১৮। 
  14. জেমস চার্লস জ্যাক (১৯১৮)। Bakarganj (ইংরেজি ভাষায়)। বেঙ্গল সেক্রেটেরিয়াট বুক ডেপার্টমেণ্ট। পৃষ্ঠা ১৩৪। 
  15. বিশ্ব বিশ্বাস (১৯৭০)। বিপ্লবী সতীন সেন। বিশ্বাস পাব্লিশিং হাউজ। পৃষ্ঠা ৬। 
  16. আহমেদ (২০১০), p. Vol. 1, কেওড়ার বাকলাই পরিবার.
  17. ইসলামী বিশ্বকোষ২১ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ। পৃষ্ঠা ৩৩৮। 

কেতাবাদি

সম্পাদনা
  • আহমেদ, সিরাজ উদ্দিন (২০১০)। বরিশাল বিভাগের ইতিহাসঢাকা: ভাস্কর প্রকাশনী।