কিনানা
কিনানা (আরবি: كِنَاَنَة, প্রতিবর্ণীকৃত: Kināna) তিহামা উপকূলীয় অঞ্চল ও হেজাজ পর্বতমালায় মক্কার আশেপাশে অবস্থিত একটি আরব উপজাতি ছিল।[১] মক্কার কুরাইশ তথা ইসলামি নবী মুহাম্মদের গোত্র ছিল কিনানার একটি শাখা। সমগ্র আরব বিশ্ব জুড়ে আধুনিক যুগের বেশ কয়েকটি উপজাতির সাথে তাদের বংশের সম্পর্ক রয়েছে।[২]
কিনানা بَنُو كِنَاَنَة | |
---|---|
মুদারীয় আরব গোত্র | |
নিসবা | আল-কিনানি الْكِنَانِيّ |
অবস্থান | মক্কার নিকটবর্তী তিহামা ও হেজাজ এলাকা (৫ম শতাব্দী-বর্তমান) ফিলিস্তিন (৭ম-১২তম শতাব্দী) |
এর বংশ | কিনানা ইবনে খুযায়মা ইবনে মুদরিকা ইবনে ইলিয়াস ইবনে মুদার |
শাখা | |
ধর্ম | ইসলাম |
অবস্থান
সম্পাদনাকিনানার ঐতিহ্যবাহী উপজাতীয় অঞ্চলটি মক্কার নিকট তিহামা উপকূলের অংশ থেকে উত্তর-পূর্ব দিকে তাদের উপজাতীয় আত্মীয় বনু আসাদের অঞ্চলের সীমানা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।[৩]
ইতিহাস
সম্পাদনাউৎপত্তি ও শাখা
সম্পাদনাআরব বংশানুক্রমিক ঐতিহ্যে অনুযায়ী এই উপজাতির পূর্বপুরুষ ছিলেন কিনানা ইবনে খুজাইমা ইবনে মুদরিকা ইবনে ইলিয়াস।[৪] ইসলামের আসার পূর্বে এই উপজাতিটি মক্কার দেবী যেমন আল-লাতা, উজ্জা ও মানাতার উপাসকদের বংশধর বলে দাবি করে। ইসলামিকরণের পর উপজাতিটি নিজেদের ইসমাইলের পূর্বপুরুষের অংশ ঘোষণা করে, যিনি আরবের জুরহুম উপজাতির একজন মহিলাকে বিয়ে করেছিলেন ও ইসলামী ঐতিহ্য অনুসারে মক্কার আশেপাশে বসতি স্থাপন করেছিলেন।[৫] কিনানারা ছিল মুশরিক, তাদের উপাসনা দেবী আল-উজ্জাকে ঘিরে কেন্দ্রীভূত ছিলো। তারা উত্তর আরবের বাইরে ইরাক, ইরান ও আফগানিস্তানের আধুনিক অঞ্চল থেকে উদ্ভূত হয়েছিল। ইসলামি ঐতিহ্য বলে যে কিনানা ও ইসমাইলের অন্যান্য বংশধররা ধীরে ধীরে উত্তর আরবে ছড়িয়ে পড়ে এবং তাদের আসল ধর্মবিশ্বাস হারিয়ে মূর্তিপূজায় জড়িয়ে পড়ে।[৫]
নদর, মালিক, মিলকান, আমির, আমর এবং আবদ মানাত গোষ্ঠী নামক এই গোত্রের ছয়টি মূল শাখা ছিল। নাদর ছিল আদি কুরাইশ গোত্র, ইসলামী নবী মুহাম্মদের গোত্র হল কুরাইশ যা কিনানা থেকে স্বাধীনভাবে গণনা করা হত। দেবী মানাতের উপাসক আব্দ মানাত, বকর ইবনে আবদ মানাত-এর বিশেষভাবে শক্তিশালী উপগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত ছিল, যার প্রধান শাখা ছিল মুদলিজ, দুইল, লায়থ এবং দামরা। গিফার উপগোষ্ঠীটি দামরার অন্তর্গত ছিল বা সরাসরি আবদ মানাত থেকে উদ্ভূত হয়েছিল। আরেকটি শাখা, হারিস ইবনে আবদ মানাত, আহবিশ গোষ্ঠীর মূল গঠন করেছিল, ছোট, সম্ভবত সম্পর্কহীন, গোষ্ঠীর একটি সমাবেশ।[৩]
কুরাইশদের পূর্বপুরুষ ফিহর ইবনে মালিক ইবনে নাদর দক্ষিণ আরবের হিমিয়ারদের একটি শাখার বিরুদ্ধে অজানা তারিখে বিজয় অর্জনে কিনানার নেতা হিসাবে আবির্ভূত হন। তার বংশধর কুসাই ইবনে কিলাব, কাবার আবাসস্থল মক্কার পবিত্র শহর দখলে কিনানাদের সমর্থন করেছিল। লায়থ গোষ্ঠীর কিনানীয় প্রধান ইয়া'মার ইবনে আমরের সমর্থনে উপজাতিদের মধ্যে কুসাইয়ের অবস্থান আরও শক্তিশালী হয়েছিল; বকর সাধারণত কুসাইয়ের বিরোধিতা করতেন। ফিজার যুদ্ধ বানু কিলাবের একজন প্রধানকে কিনানী আল-বারাদ ইবনে কায়সের দ্বারা হত্যার মাধ্যমে শুরু হয়েছিল, যিনি তার গোত্র দ্বারা নির্বাসিত দামরার একজন ব্যক্তি ছিলেন কিন্তু তাকে দু'ইলরা সুরক্ষা দেয় ও কুরাইশ প্রধান হারব ইবনে উমাইয়ার সাথে সংঘবদ্ধ সম্পর্ক বজায় রাখে। কিলাব ও তাদের হাওয়াযিন গোত্রীয় আত্মীয়রা প্রতিশোধ হিসেবে কুরাইশদের বিরুদ্ধে অগ্রসর হয় ও বকরসহ কিনানারা কুরাইশদের সমর্থনে আসে। বকর কুরাইশদের প্রতি শত্রুতা পোষণ করে ও উত্তেজনা বৃদ্ধি পায় যখন একজন কুরাইশ যুবকের কিনানীয় দ্বারা হত্যার প্রতিশোধ নিতে বকরের একজন প্রধানকে হত্যা করা হয়; উপজাতীয় রীতিনীতি যুবকদের প্রধানের সমান মর্যাদা দেয়নি।[৩]
প্রারম্ভিক ইসলামি যুগ
সম্পাদনাইসলামের ইতিহাসবিদরা মুহাম্মাদের সময়ে একটি ঐক্যবদ্ধ উপজাতি হিসেবে কিনানার ক্রিয়াকলাপকে লক্ষ্য করেননি, যদিও কুরাইশ সহ গোত্রের বেশ কয়েকটি শাখা ইসলামের গঠন ও প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।[২] কুরাইশরা প্রথমে মুহাম্মদ ও তার একেশ্বরবাদী বার্তার বিরোধিতা করেছিল, কিন্তু বকরের সাথে পূর্ববর্তী উত্তেজনার কারণে, কিনানার নিরাপত্তার নিশ্চয়তা ছাড়াই ৬২৪ সালে বদরে তার ও তার অনুসারীদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে দ্বিধাবোধ করেছিল। মুদলিজ গোষ্ঠী পেছন থেকে কুরাইশদের আক্রমণ না করার প্রতিশ্রুতি দেয় ও এইভাবে তারা মুহাম্মদের বিরুদ্ধে অগ্রসর হয়, যিনি তাদের সেই সংঘাতে পরাজিত করেছিলেন। পরবর্তীতে খুজা'র উপর বকরের আক্রমণ মুহাম্মদের মিত্রদের নবীকে ৬৩০ সালে মক্কা আক্রমণ শুরু করতে প্ররোচিত করে। এতে তিনি গিফার, লায়থ ও দামরার সমর্থন লাভ করেন।[৬]
মক্কা বিজয়ের পর কিনানা সম্পর্কে খুব কম তথ্য পাওয়া যায়। দু'ইলের একজন গুরুত্বপূর্ণ উপজাতি সদস্য আবু আল আসওয়াদ আদ-দুওয়ালি খলিফা আলীর মিত্র হিসাবে গণ্য হন, যিনি মুহাম্মদের চাচাতো ভাই এবং জামাতা ছিলেন।[৬] কিনানা ছিল ৬৩০-এর দশকে মুসলমানদের বিজয়ের পর জুন্দ ফিলাস্তিনের (ফিলিস্তিনের সামরিক জেলা) আরব উপজাতীয় সেনাদলের অন্যতম প্রধান উপাদান; অন্যান্য প্রধান উপাদান ছিল জুধাম, লাখম, খুজাআ, খাতআম এবং আজদ।[৭] খলিফা উমর (শা. ৬৩৪–৬৪৪) কিনানার দুই ব্যক্তি আলকামা ইবনে মুজাজ্জিজ ও আলকামা ইবনে হাকিমকে ফিলিস্তিনের দ্বৈত গভর্নর হিসেবে নিযুক্ত করেন, যারা প্রাক্তন হিসেবে জেরুসালেমের ও পরবর্তীরা সম্ভবত ৬৩৮/৬৩৯ সালের দিকে লিড্ডায় কর্মরত ছিলেন;[৮] যারা খলিফা উসমান কর্তৃক মুয়াবিয়া ইবনে আবু সুফিয়ানের স্থলাভিষিক্ত হওয়া পর্যন্ত পরবর্তী গভর্নর ছিলেন (শা. ৬৪৪–৬৫৬)। উমাইয়া খলিফা দ্বিতীয় ইয়াজিদের (শা. ৭২০–৭২৪) গায়িকা, হাব্বাবা, শ্লোকে ফিলিস্তিনে কিনানার উপস্থিতি উল্লেখ করেছেন:
আমার চারপাশে কিনানার দল
ফিলিস্তিনে, দ্রুত গতিতে তাদের ঘোড়দৌড়।[৯]
৮৪৪/৪৫ সালে মক্কার আশেপাশে কিনানা দুর্বল হয়ে পড়লেও তাদের উপস্থিতি বজায় ছিল বলে নথিভুক্ত করা হয়েছে।[৬]
মধ্য ইসলামী যুগ
সম্পাদনা১১৫৩ সালে ক্রুসেডারদের দ্বারা বন্দর শহর আসকেলন দখলের পর দক্ষিণ ফিলিস্তিনের কিনানার আমির ও জাহাতদাররা ফাতেমিদ মিশরে চলে যান। ফাতেমীয় উজিরে আজম তালাই ইবনে রুজিক উপজাতিদের দমইয়াত ও এর আশেপাশে তাদের পুনর্বাসিত করেছিলেন যেখানে তারা কিনানিয়া নামে পরিচিত হয়েছিল। আইয়ুবীয়দের অধীনে কিনানিয়াকে আর্থিকভাবে দ্বিতীয় স্তরের সৈন্য হিসাবে গণনা করা হয়েছিল এবং তাদেরকে কুর্দি, তুর্কি ও তুর্কমেন সৈন্যদের হারের অর্ধেক অর্থ প্রদান করা হতো, তবে তা ছিলো আরব সহায়ক সেনাদের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি।[১০] কিনানীয় উপজাতিরা রামলার কাছে মন্টগিসার্ডের যুদ্ধে ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে আইয়ুবী সুলতান সালাদিনের কমান্ডার কাদি আল-ফাদিলের সাথে যুদ্ধ করেছিল, যেখানে সালাদিনের বাহিনী পরাজিত হয়েছিল।[১০] সম্ভবত দক্ষিণ ফিলিস্তিনের রামলার আশেপাশের এলাকার সাথে তাদের পরিচিতির কারণে তাদের ব্যবহার করা হয়েছিল।[১০]
জুন ১২৪৯-এ ৭০০ জাহাজ বিশিষ্ট নবম লুইসের নৌবাহিনী সপ্তম ক্রুসেডের অংশ হিসেবে দমইয়াতে পৌঁছায়। সাহসীকতার জন্য পরিচিত শহরটির কিনানি বাহিনী ক্রুসেডারদের পৌঁছানো সেখামাত্রই ফখর আল-দিন নেতৃত্বাধীন মিশরীয় বাহিনীর সাথে পালিয়ে যায়।[১১] আইয়ুবীয় সুলতান সালিহ আইয়ুব ফলস্বরূপ কিনানীয় মরুভূমির কমান্ডারদের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করে।[১২][১৩]
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ Watt, W. Montgomery। "Kinana"। Brill। ২৩ অক্টোবর ২০১৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২২ অক্টোবর ২০১৮।
- ↑ ক খ "Kinana"। E. J. Brill's First Encyclopaedia of Islam, 1913-1936, Volume 4। ১৯৯৩। পৃষ্ঠা 1017–1018। আইএসবিএন 9789004097902।
- ↑ ক খ গ Watt।
- ↑ Ibn Ishaq (১৯৫৫)। The Life of Muhammad: A Translation of Ibn Isḥāq’s sīrat। পৃষ্ঠা 3, 38–41, 52–53। আইএসবিএন 0195778286।
- ↑ ক খ Peters, Francis E.। Muhammad and the Origins of Islam। পৃষ্ঠা 5–15।
- ↑ ক খ গ Watt 1986।
- ↑ Crone 1980।
- ↑ Gil 1997।
- ↑ Jayyusi 2010।
- ↑ ক খ গ Gibb।
- ↑ Lane-Pool 2013, পৃ. 238।
- ↑ Runciman 1951, পৃ. 221।
- ↑ Lane-Poole 2013, পৃ. 232–233।
গ্রন্থপঞ্জি
সম্পাদনা- Crone, Patricia (১৯৮০)। Slaves on Horses: The Evolution of the Islamic Polity। Cambridge: Cambridge University Press। আইএসবিএন 0-521-52940-9।
- গিল, মোশে (১৯৯৭) [১৯৮৩]। A History of Palestine, 634–1099 [ফিলিস্তিনের একটি ইতিহাস, ৬৩৯–১০৯৯]। Ethel Broido কর্তৃক অনূদিত। ক্যামব্রিজ: ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় প্রেস। আইএসবিএন 0-521-59984-9।
- Jayyusi, Salma Khadra (২০১০)। Classical Arabic Stories: An Anthology। New York: Columbia University Press। আইএসবিএন 978-0-231-14922-8।
- Watt, W. Montgomery (১৯৮৬)। "Kināna"। Bosworth, C. E.; van Donzel, E.; Lewis, B. & Pellat, Ch.। The Encyclopaedia of Islam, New Edition, Volume V: Khe–Mahi। Leiden: E. J. Brill। পৃষ্ঠা 116। আইএসবিএন 90-04-07819-3।