কাসিম ইবনে হাসান (৬৬৭ থেকে ৬৮০ খ্রিস্টাব্দ) ছিলেন ইমাম হাসান ইবনে আলীর পুত্র। তিনি কারবালার যুদ্ধের সময় উমাইয়া বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তার চাচা হোসাইন ইবনে আলীকে সমর্থন করেছিলেন এবং সেখানে তিনি নিহত হয়েছিলেন [][] মাত্র ১৩ বছর বয়সে।[]

কাসিম ইবনে হাসান
القاسم ابن الحسن ابن علي
ব্যক্তিগত তথ্য
জন্ম৭ শাবান, ৪৭ হিজরি / ৪ অক্টোবর, ৬৬৭ খ্রিস্টাব্দ
মৃত্যু১০ মহররম, ৬১ হিজরি / ১০ অক্টোবর, ৬৮০ খ্রিস্টাব্দ (১৩ বছর বয়সে)
সমাধিস্থলইমাম হোসাইনের মাজার
দাম্পত্য সঙ্গীসখিনা বিনতে হোসেন
পিতামাতা

প্রাথমিক জীবন

সম্পাদনা

কাসিম ইবনে হাসানের বাবার নাম হাসান ইবনে আলী এবং মায়ের নাম উম্মে ফারওয়া। তার বাবা ছিলেন আলি ইবনে আবু তালিব এবং ফাতেমা বিনতে মুহাম্মাদের বড় ছেলে। এই সূত্রে কাসিম হলেন ইসলামের শেষ নবী মুহাম্মাদ (সা:) এর প্রপৌত্র।

হাসান ইবনে আলীর মৃত্যু

সম্পাদনা

২ এপ্রিল, ৬৭০ খ্রিস্টাব্দে হাসান ইবনে আলী নিহত হন। উমাইয়া খলিফা মুয়াবিয়া এবং তার পুত্র ইয়াজিদের চক্রান্তে বিষপ্রয়োগ করে তাকে হত্যা করা হয়।[] কাসিমের বয়স যখন মাত্র তিন বছর, তখন তার বাবা এভাবে মারা যান। তবে তিনি তার পৈতৃক পরিবারের সান্নিধ্যে বড় হয়েছেন। তার ফুফু জয়নাব বিনতে আলীর ছেলে আউন এবং মুহাম্মদের সাথে কাসিম শৈশব কাটিয়েছেন। তারা সবাই আব্বাস ইবনে আলী এবং আলী আকবর ইবনে হোসাইনের কাছে যুদ্ধবিদ্যা শিখতেন। [] ৬৮০ খ্রিস্টাব্দে হোসাইন ইবনে আলী যখন কুফার উদ্দেশ্যে মদিনা ত্যাগ করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, তখন কাসিমের মা উম্মে ফারওয়া হোসাইনকে অনুরোধ করেছিলেন যেন তাকে এবং তার ছেলে যুবক কাসিমকে তার সাথে নিয়ে যান।[]

কারবালার যুদ্ধে অংশগ্রহণ

সম্পাদনা

মৃত্যুর পূর্বে উমাইয়া শাসক মুয়াবিয়া তার প্রথম পুত্র ইয়াজিদকে উত্তরাধিকারী নিযুক্ত করেন।[] কিন্তু ইয়াজিদের ক্ষমতা গ্রহণ জনগণের মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টি করলো। অনেকে তার কর্তৃত্ব মেনে নিলেও হোসাইন ইবনে আলী মেনে নিলেন না। [] তার কাছ থেকে আনুগত্য লাভের মাধ্যমে ইয়াজিদ ধর্মীয় কর্তৃত্ব লাভের কামনা করেছিল। কিন্তু হোসাইন তার নীতি ত্যাগ করেননি। কুফাবাসীরা হোসাইনের কাছে চিঠি পাঠিয়ে তাঁর সাহায্য প্রার্থনা করে। তাঁর প্রতি আনুগত্যের অঙ্গীকার করে। ফলশ্রুতিতে হোসাইন এবং তাঁর পরিবারের সদস্যরা (কাসিম ইবনে হাসান সহ) তাঁদের সঙ্গীদের নিয়ে মদিনা থেকে মক্কায় গমন করেন। এরপর মক্কা থেকে ইরাকের কুফায় যাত্রা করেন। কিন্তু পথিমধ্যে কারবালায় যাত্রাবিরতি করতে বাধ্য হন। ১০ অক্টোবর, ৬৮০ খ্রিস্টাব্দে ইয়াজিদ বাহিনীর সাথে ইমাম হোসাইনের ঐতিহাসিক কারবালার যুদ্ধ সংঘটিত হয়।[] কাসিম ইবনে হাসান এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। যুদ্ধে তার বেশিরভাগ পরিবার ও সঙ্গী নিহত হন। হোসাইনের শিরশ্ছেদ করা হয়। পরিবারের নারী ও শিশুদের বন্দী করে নিয়ে দামেস্কে নিয়ে যাওয়া হয়।[] যুদ্ধের ময়দানে কাসিম তার চাচাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, 'আমিও কি শহীদদের অন্তর্ভুক্ত হব?' হোসাইন ইবনে আলী উত্তর দিলেন, 'তুমি মৃত্যুকে কিভাবে দেখছ?' কাসিম বললেন, 'হে চাচা, আমার কাছে মৃত্যু মধুর চেয়েও মিষ্টি।' কাসিম বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করে এবং নিহয় হয়। [১০]

আশুরার দিন

সম্পাদনা

আশুরা অর্থাৎ কারবালার যুদ্ধের দিন কাসিম তার আগে যুদ্ধে যাওয়া অন্য চাচাতো ভাইদের মতো তার চাচা হোসাইনের কাছে অনুমতি চাইতে যান। হোসাইন তাকে যুদ্ধ করার অনুমতি দিলেন না, কারণ তিনি যুদ্ধ করার জন্য খুবই ছোট ছিলেন। তার বয়স ছিলো মাত্র ১৩ বছর। যুদ্ধের তার সাথে খারাপ কিছু ঘটতে পারে ভেবে হোসাইন তাকে যুদ্ধে যেতে দিতে চান নি। এরপর কাসিম তার মায়ের কাছে চলে যান। কিন্তু তার মা-ও তাকে যুদ্ধে যাওয়ার অনুমতি দিলেন না। পরবর্তীতে যখন তার মা দেখলেন যে, যুদ্ধে না যেতে পেরে কাসিমের মন খারাপ, তখন তিনি তাকে একটি চিঠি দিলেন যা কাসিমের বাবা তার মৃত্যুর আগে লিখেছিলেন। চিঠিতে বলা হয়েছে:

আমার ছেলে কাসিম, এমন একটি দিন আসবে যখন আমার ভাই হোসেন হাজার হাজার শত্রু বাহিনীর মুখোমুখি হবে। সেদিন ত্যাগের মাধ্যমে ইসলামকে বাঁচাতে হবে। সেই দিন তোমাকে অবশ্যই আমার প্রতিনিধিত্ব করতে হবে।.[]

কাসিম চিঠি পড়ে চাচাকে দিলেন। চিঠি পড়ে হোসাইন বললেন,

হে আমার ভাইয়ের ছেলে, তোমার বাবা তোমাকে যা করতে চেয়েছিলেন তা থেকে আমি কীভাবে তোমাকে বাধা দেব? আল্লাহর নামে, যাও! আল্লাহ তোমার সাথে থাকুন!

তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়ে বহু যোদ্ধাকে হত্যা করেন। পেছন থেকে একজন এসে কাসিমের মাথায় আঘাত করে। তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন, প্রচন্ড রক্তক্ষরণ হয়।[] তখন তিনি তার চাচাকে ডাকলেন। হোসেন ছুটে গেলেন। ইয়াজিদের বাহিনী তাদের আক্রমণ করতে আসে। তারা ঘোড়া নিয়ে একদিক থেকে অন্য দিকে ছুটতে থাকে। ফলে কাসিমের দেহ ঘোড়ার পায়ের নিচে দলিত হতে থাকে এবং সে মারা যায়।[১১] হোসাইন তাকে ডাকলেন, কিন্তু কোন উত্তর এলো না। যখন তারা তার লাশ দেখতে পায়, তখন হোসাইন তার আবা (আরবের একধরনের পোশাক) খুলে ফেলেন এবং তার দেহাবশেষ সংগ্রহ করেন।[১২]

১০ অক্টোবর, ৬৮০ খ্রিস্টাব্দে আশুরার দিন কাসিম ইবনে হাসান ফোরাত নদীর কাছে নিহত হন। কাসিম ইবনে হাসানসহ হোসাইনের ৭২ জন সাহাবীকে কারবালায় দাফন করা হয়। কাসিমের গণকবরটি হোসাইনের কবরের পাদদেশে অবস্থিত।[১৩]

প্রভাব

সম্পাদনা

কাসিম ইবনে হাসানের বীরত্ব নিয়ে বাংলা ভাষায় কবি হামিদ আলি লিখেছেন তার বিখ্যাত মহাকাব্য 'কাসেম বধ কাব্য'।[১৪] এছাড়া মীর মশাররফ হোসেন তার অমর সৃষ্টি বিষাদ সিন্ধুতে কাসিমের সংগ্রাম নিয়ে বিস্তৃত পরিসরে লিখেছেন। ইসলামি বিশ্বে, বিশেষ করে শিয়া দৃষ্টিভঙ্গিতে অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়পরায়ণতা এবং প্রতারণার বিরুদ্ধে সত্যের সংগ্রামে শুধুমাত্র হোসাইনের দুঃখ-কষ্ট ও মৃত্যুই ত্যাগের প্রতীক হয়ে ওঠেনি, বরং তার সঙ্গীরাও হয়ে ওঠেছেন প্রতিরোধের প্রতীক, অনুপ্রেরণাদায়ক। অত্যাচারী ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে তাদের সংগতাম ইতিহাস জুড়ে প্রভাব বিস্তার করেছে। যেমন, নেলসন ম্যান্ডেলা এবং মহাত্মা গান্ধীর মতো অনেক উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব,[১৫] অন্যায়ের বিরুদ্ধে তাদের নিজেদের লড়াইয়ের উদাহরণ হিসাবে নিপীড়নের বিরুদ্ধে হোসাইনের অবস্থানকে উদ্ধৃত করেছেন। কারবালায় হোসাইন ও তার সঙ্গীদের মৃত্যুকে শিয়া ও সুন্নি উভয়ই অত্যাচারী শাসকদের প্রতিরোধ এবং নীতি রক্ষার জন্য একটি আত্মত্যাগ বলে বিশ্বাস করে।[১৬][১৭]

তথ্যসূত্র

সম্পাদনা
  1. Mahmoud M. Ayoub (১ জানুয়ারি ১৯৭৮)। Redemptive Suffering in Islam: A Study of the Devotional Aspects of Ashura in Twelver Shi'ism। Walter de Gruyter। পৃষ্ঠা 117। আইএসবিএন 978-3-11-080331-0 
  2. "Archived copy" (পিডিএফ)। ২০১৪-০১-০১ তারিখে মূল (পিডিএফ) থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৩-১২-৩১ 
  3. Ibn El-Neil (১ নভেম্বর ২০০৮)। The Truth About Islam। Strategic Book Publishing। পৃষ্ঠা 208। আইএসবিএন 978-1-60693-259-9 
  4. Madelung, Wilferd (১৯৯৭)। The Succession to Muhammad: A Study of the Early CaliphateCambridge University Pressআইএসবিএন 978-0-521-64696-3 
  5. Abbas, Zaynab (২৩ সেপ্টেম্বর ২০০৪)। "Hazrat Qasim (as) – coolness of Imam Hassan (as)'s heart"। Jafariyanews। ৯ জুলাই ২০১৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৩ নভেম্বর ২০১৫ 
  6. Lewis, Bernard (মে ২৩, ২০০২)। The Arabs in History। Oxford University Press; 6th edition (May 23, 2002)। পৃষ্ঠা 67। আইএসবিএন 978-0192803108 
  7. Madelung, Wilferd"HOSAYN B. ALI"Iranica। ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১২ জানুয়ারি ২০০৮ 
  8. Wellhausen, Julius (১৯০১)। Die religiös-politischen Oppositionsparteien im alten Islam (জার্মান ভাষায়)। Berlin: Weidmannsche Buchhandlung। ওসিএলসি 453206240 
  9. Gordon, Matthew S. (মে ৩০, ২০০৫)। The Rise of Islam। Greenwood; Annotated edition (May 30, 2005)। পৃষ্ঠা 144–146। আইএসবিএন 978-0313325229 
  10. Bashir A. Datoo (২০০৬)। Perspectives on Islamic Faith and History: A Collection of Analytical Essays। TTQ, INC.। পৃষ্ঠা 89। আইএসবিএন 978-1-879402-17-1 [স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
  11. "The Night of al-Qasim ibn Hassan hold in Stockholm, Sweden / Photos"Ahlul Bayt News Agency (press release)। অক্টোবর ১৭, ২০১৫। 
  12. Seyed Ibn Tawus (৪ জানুয়ারি ২০১৪)। Lohoof Sighs of Sorrow। Createspace Independent Pub। পৃষ্ঠা 68–69। আইএসবিএন 978-1494883652 
  13. F. Biondo, D. Hecht, Vincent, Richard (২৫ মার্চ ২০১০)। Religion and Everyday Life and Culture, vol3। Praeger (March 25, 2010)। পৃষ্ঠা 639। আইএসবিএন 978-0313342783 
  14. "আলী, আবুল ম' আলী মুহাম্মদ হামিদ - বাংলাপিডিয়া"bn.banglapedia.org। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-০৮-২৮ 
  15. Rizvi, Dr. S. Manzoor (অক্টোবর ১৪, ২০১৪)। Unique Sacrifice of Imam Hussain for Humanity। পৃষ্ঠা 372। আইএসবিএন 978-1312483323 
  16. Nakash, Yitzhak (১৯৯৩)। "An Attempt To Trace the Origin of the Rituals of 'Āshūrā¸"। Die Welt des Islams33 (2): 161–181। ডিওআই:10.1163/157006093X00063 
  17. Brunner, Rainer (২০১৩)। "Karbala"। Bowering, Gerhard; Crone, Patricia; Mirza, Mahan; Kadi, Wadad; Zaman, Muhammad Qasim; Stewart, Devin J.। The Princeton Encyclopedia of Islamic Political Thought। New Jersey: Princeton University Press। পৃষ্ঠা 293। আইএসবিএন 9780691134840