কাশ্মীর

দক্ষিণ এশিয়ার উত্তরপশ্চিমে অবস্থিত অঞ্চল

কাশ্মীর হল ভারতীয় উপমহাদেশের উত্তরপশ্চিমের একটি অঞ্চল। ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্ত কাশ্মীর শব্দটি ভৌগোলিকভাবে শুধু হিমালয় পর্বতমালা এবং পীর পঞ্জল পর্বতমালার উপত্যকাকে নির্দেশ করা হতো। আজ কাশ্মীর বলতে বোঝায় একটি বিশাল অঞ্চল যা ভারতীয়-কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল জম্মু ও কাশ্মীরলাদাখ , পাকিস্তানি-শাসিত গিলগিত-বালতিস্তানআজাদ কাশ্মীর প্রদেশ এবং চীন-শাসিত আকসাই চীনট্রান্স-কারাকোরাম ট্রাক্ট অঞ্চলসমূহ নিয়ে গঠিত।[][][]

রাজনৈতিক মানচিত্র: কাশ্মীর অঞ্চলের জেলাসমূহ, পীর পঞ্জল পর্বতমালা ও কাশ্মীর উপত্যকা
নবম-সর্বোচ্চ: নঙ্গ পর্বত, আরোহণের জন্য মারাত্মক একটি পর্বত, এটি পাকিস্তানে গিলগিত-বালতিস্তানের কাশ্মীর অঞ্চলে অবস্থিত।

১৮২০ সালে মহারাজ রঞ্জিত সিং কাশ্মীরকে শিখ সাম্রাজ্যভুক্ত করে । ১৮৪৬ সালে, প্রথম অ্যাংলো-শিখ যুদ্ধে শিখদের পরাজয়ের পর এবং অমৃতসর চুক্তির মাধ্যমে ব্রিটিশদের কাছ থেকে এই অঞ্চল কেনার পর, জম্মুর রাজা গুলাব সিং কাশ্মীরের নতুন শাসক হন। তার বংশধরদের শাসন, ব্রিটিশ রাজত্বের অধীনে, ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাজন পর্যন্ত স্থায়ী হয়েছিল। ভারত ভাগের পর ভারত, পাকিস্তান ও চীন এই তিন দেশই এর কিছু বা সম্পূর্ণ অংশের স্বত্ব দাবী করে, ফলে ব্রিটিশ ভারতীয় সাম্রাজ্যের প্রাক্তন রাজকীয় রাজ্যটি একটি বিতর্কিত অঞ্চলে পরিণত হয়।

১ম সহস্রাব্দের প্রথমার্ধে কাশ্মীর অঞ্চল হিন্দুধর্ম ও পরে বৌদ্ধধর্মের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হয়ে ওঠে, পরে নবম শতাব্দীতে কাশ্মীরে শাইভিবাদের উত্থান ঘটে।[] ১৩৩৯ সালে শাহ মীর কাশ্মীরের প্রথম মুসলমান শাসক হন এবং সালতিন-ই-কাশ্মীর বা শাহ মীর রাজবংশের গোড়াপত্তন করেন।[] কাশ্মীর ১৫৮৬ থেকে ১৭৫১ সাল পর্যন্ত মুঘল সাম্রাজ্যের অংশ ছিল, এবং পরে ১৮২০ সাল পর্যন্ত আফগান দুররানি সাম্রাজ্যের অংশ ছিল।[] এই বছর রঞ্জিত সিঙের নেতৃত্বে শিখরা কাশ্মীর দখল করে।[] ১৮৪৬ সালে প্রথম ইঙ্গ-শিখ যুদ্ধে শিখরা পরাজিত হয় এবং জম্মুর রাজা গুলাব সিং অমৃতসর চুক্তির মাধ্যমে ব্রিটিশদের কাছ থেকে এই অঞ্চল ক্রয় করে কাশ্মীরের নতুন শাসক হন। তার উত্তরসূরীরা ব্রিটিশদের অধীনে এই অঞ্চল শাসন করে ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাজনের পূর্ব পর্যন্ত। ভারত বিভাজনের পর সাবেক ব্রিটিশ ভারতীয় সাম্রাজ্যের এই রাজ্যটি অমীমাংসিত অঞ্চলে পরিণত হয় এবং বর্তমানে এটি তিনটি দেশ কর্তৃক শাসিত হচ্ছে, দেশ তিনটি হল ভারত, পাকিস্তানচীন[][]

ব্যুৎপত্তি

সম্পাদনা

কাশ্মীর নামটি সংস্কৃত শব্দ 'কাশ্মীরা' থেকে উৎপত্তি হয়েছে বলে মনে করা হয় । নীলমত পুরাণ অনুসারে সতী-সরস নামক হ্রদ থেকে এই উপত্যকার উৎপত্তি ঘটে।[][] স্থানীয় জনশ্রুতি অনুসারে কাশ্মীর শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হল 'জল থেকে উদ্ভূত ভূমি'।[]

[] লোক ভাষ্য মতে কাশ্মীর শব্দটি এসেছে বৈদিক ঋষি "কাশ্যপ " এর নাম থেকে। যিনি এই ভূমিতে মনুষ্য বসতি স্থাপন করেছিলেন বলে বিশ্বাস করা হয়। তদনুসারে, কাশ্মীর শব্দটি এসেছে কাশ্যপের হ্রদ অথবা কাশ্যপের পর্বত শব্দ থেকে।

কাশ্মীর একটি হিন্দু ধর্মগ্রন্থের মন্ত্রে উল্লেখ পাওয়া যায়, যেটিতে কাশ্মীর ভূমিতে অবস্থানরত দেবী সারদার স্তুতি করা হয়েছে। যা সারদা পীঠ নামক তীর্থ স্থানের উল্লেখ হতে পারে।

প্রাচীন গ্রীকরা এই অঞ্চলটিকে কাস্পেরিয়া নামে অভিহিত করত। মিলিতাসের হেকাটেয়াস (বাইজান্টিয়ামের আপুড স্টেফানাস) এবং হেরোডোটাসের কাসপাটাইরোস (3.102, 4.44) নামে যে স্থানের উল্লেখ করা হয়েছে এটি গ্রীক উচ্চারনে কাশ্মীর শব্দেরই নামান্তর ভাবা হয়। টলেমির কাসপিরিয়া দেশ বলতে কাশ্মীরকেই বুঝানো হয়েছে।

প্রাচীনতম পান্ডুলিপি যা সরাসরি কাশ্মীর নামটির উল্লেখ করে তা হল খ্রিস্টপূর্ব ৫ম শতাব্দীতে সংস্কৃত ব্যাকরণবিদ পাণিনি রচিত অষ্টাধ্যায়ী গ্রন্থে। পাণিনি কাশ্মীরের জনগণকে কাশ্মীরিকা বলে অভিহিত করেন।

সভা পর্বে মহাভারতে এবং মৎস্য পুরাণ, বায়ু পুরাণ, পদ্ম পুরাণ, বিষ্ণু পুরাণ, বিষ্ণুধর্মোত্তর পুরাণ প্রভৃতি পুরাণগুলিতে কাশ্মীরের আরও কিছু প্রাথমিক উল্লেখ পাওয়া যায়।

বৌদ্ধ পণ্ডিত এবং চীনা ভ্রমণকারী হুয়েনসাং কাশ্মীরকে কিয়া-শি-মিলো নামে অভিহিত করেছেন, অন্যদিকে কিছু চীনা বর্ণনা কাশ্মীরকে কি-পিন (বা চিপিন বা জিপিন) এবং আচে-পিন বলে উল্লেখ করেছে। কাশ্মীরি ভাষায়, কাশ্মীর নিজেই কাশির নামে পরিচিত।

পরিভাষা

ভারত সরকার এবং ভারতীয় সূত্র, পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণাধীন অঞ্চল "পাকিস্তান-অধিকৃত কাশ্মীর" উল্লেখ করে। পাকিস্তান সরকার এবং পাকিস্তানি সূত্রগুলি ভারত দ্বারা শাসিত কাশ্মীরের অংশকে "ভারত-অধিকৃত কাশ্মীর" হিসাবে উল্লেখ করে।

ইতিহাস

সম্পাদনা

প্রথম সহস্রাব্দের শুরুর দিকে, কাশ্মীর অঞ্চলে হিন্দুধর্ম এবং পরে বৌদ্ধ ধর্মালম্বী লোকজনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বসতি গড়ে উঠে। ৭ম-১৪ শতকের সময়, অঞ্চলটি হিন্দু রাজবংশ দ্বারা শাসিত হয়েছিল এবং কাশ্মীর শৈববাদের উদ্ভব হয়েছিল। ১৩৩৯ সালে, শাহ মীর কাশ্মীরের প্রথম মুসলিম শাসক হন, সালাতিন-ই-কাশ্মীর বা শাহ মীর রাজবংশের উদ্বোধন করেন। অঞ্চলটি ১৫৮৬ থেকে ১৭৫১ সাল পর্যন্ত মুঘল সাম্রাজ্যের অংশ ছিল, পরবর্তিতে ১৮২০ সাল পর্যন্ত আফগান দুররানি সাম্রাজ্যের অধীনে শাসিত হয়েছিল।

প্রাচীন ইতিহাস

সম্পাদনা

শাহ মীর রাজবংশ

সম্পাদনা

শামস-উদ-দীন শাহ মীর (শাসনকাল ১৩৩৯-৪২) ছিলেন কাশ্মীরের প্রথম মুসলমান শাসক এবং শাহ মীর রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা।

মুঘল শাসনামল

সম্পাদনা

মুঘল সম্রাট আকবর ১৫৮৫-৮৬ সালে কাশ্মীরের আন্তঃ সুন্নী-শিয়া বিভাজনের সুযোগ দিয়ে কাশ্মীর জয় করেন।

আফগান শাসনামল

সম্পাদনা

আফগান দুররানি রাজবংশ ১৭৫১ সাল থেকে কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণ লাভ করে।

শিখ শাসনামল

সম্পাদনা

১৮১৯ সালে কাশ্মীর উপত্যকা দুররানি সাম্রাজ্যের হাত থেকে পাঞ্জাবের রঞ্জিত সিংয়ের অধীনে শিখদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। আফগানদের অধীনে কাশ্মীরিরা নিপীড়িত ছিল, সেকারনে নতুন শিখ শাসকদের তারা স্বাগত জানায়। পরবর্তিতে, শিখ শাসকদেরও কঠোরতার কারনে অন্য শাসকের মত নিপীড়ক হিসাবে বিবেচিত হয়।

ব্রিটিস শাসনকানে কাশ্মীর ইউরোপীয় দর্শকদের আকৃষ্ট করতে শুরু করে, অনেক পর্যটক তাদের লেখাতে - মুসলিম কৃষকদের নিদারুণ দারিদ্র্য এবং শিখদের অধীনে অত্যধিক করের কথা উল্লেখ করেছন। উচ্চ কর অনেক কাশ্মীরি কৃষককে পাঞ্জাবের সমভূমিতে চলে যেতে বাধ্য করেছিল। শিখ সাম্রাজ্যের জন্য কাশ্মীর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রাজস্ব আয়কারী রাজ্য ছিল। ঐ সময়ে কাশ্মীরের শাল বিশ্বব্যাপী পরিচিত হয়ে ওঠে, বিশেষ করে পাশ্চাত্যের অনেক ক্রেতা আকর্ষণ করে।

মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের পর জম্মু রাজ্যটি ১৭৭০ সালে শিখদের কর্তৃত্বে আসে। পরবর্তী ১৮০৮ সালে মহারাজা রঞ্জিত সিং এটি সম্পূর্ণরূপে জয় করেন।

গুলাব সিং ১৮২২ সালে জম্মুর রাজা হিসেবে অভিষিক্ত হন। গুলাব সিং ছিলেন জম্মুর একজন যুবক, তিনি শিখ বাহিনীতে যোগদান করার পর নিজের চেষ্টা, নিষ্ঠা, দক্ষতার মাধ্যমে ধীরে ধীরে ক্ষমতার উচ্চ শিখরে উন্নীত হন। সুদক্ষ সামরিক বাহিনীর মাধ্যমে তিনি রাজৌরি (১৮২১), কিশতওয়ার (১৮২১), সুরু উপত্যকা এবং কারগিল (১৮৩৫), লাদাখ (১৮৩৪-১৮৪০) এবং বাল্টিস্তান (১৮৪০) জয় করেন, যার ফলে সমগ্র কাশ্মীর উপত্যকা জুড়ে তার রাজ্য গড়ে উঠে।

করদ রাজ্য

সম্পাদনা

১৮৪৫ সালে, প্রথম অ্যাংলো-শিখ যুদ্ধে ব্রিটিশদের জয়ের পর গুলাব সিংয়ের সাথে দুটি চুক্তি সম্পন্ন হয়। এক, যুদ্ধের ক্ষতিপুরন ১ কোটি মুদ্রা বাবদ বিয়াস ও সিন্ধু নদীর মধ্যবর্তী পার্বত্য দেশগুলি অর্থাৎ লাহোর রাজ্য ব্রিটিশদের কাছে হস্তান্তর; দুই, ৭৫ লক্ষ মুদ্রার বিনিময়ে সিন্ধু নদীর পূর্বে এবং রাভির পশ্চিমে অবস্থিত সমস্ত পাহাড়ি অঞ্চল গুলাব সিংকে প্রদান।

এই চুক্তি কাশ্মীর এবং জম্মু রাজ্যের ভিন্ন অঞ্চল, ধর্ম এবং জাতিসত্তাগুলিকে একত্রিত করেছিল। পূর্বে লাদাখ জাতিগত ও সাংস্কৃতিকভাবে ছিল তিব্বতি এবং এর অধিবাসীরা বৌদ্ধ ধর্ম পালন করত; দক্ষিণে, জম্মুতে হিন্দু, মুসলমান এবং শিখদের মিশ্র জনসংখ্যা ছিল। ঘনবসতিপূর্ণ মধ্য কাশ্মীর উপত্যকায় জনসংখ্যা অধিকাংশই ছিল সুন্নি মুসলিম, তবে সংখ্যায় কম কিন্তু প্রভাবশালী হিন্দু ব্রাহ্মণ কাশ্মীরি পণ্ডিতরাও ছিল। উত্তর-পূর্বে, অল্প জনবসতিপূর্ণ বাল্টিস্তানের একটি জনসংখ্যা জাতিগতভাবে লাদাখের সাথে সম্পর্কিত ছিল, কিন্তু সেটিতে শিয়া ইসলাম পালন করত। উত্তরে খুব কম জনবসতিপূর্ণ গিলগিট ছিল বৈচিত্র্যময় একটি এলাকা, বেশিরভাগই শিয়া গোষ্ঠী যা কাশ্মীর উপত্যকার তুলনায় একটি ভিন্ন জাতিসত্তার মুসলিম জনসংখ্যা ছিল। ১৮৫৭ সালে ভারতে সিপাহী বিদ্রোহের পর, কাশ্মীর রাজ্যও ব্রিটিশ রাজত্বের অধীনে আসে।

১৯৪১ সালের ভারতের ব্রিটিশ আদমশুমারিতে, কাশ্মীরে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসংখ্যার 77%, হিন্দু জনসংখ্যার 20% এবং বৌদ্ধ ও শিখদের একটি বিরল জনসংখ্যা বাকী 3% অন্তর্ভুক্ত ছিল। সেই বছরই একজন কাশ্মীরি পণ্ডিত সাংবাদিক (প্রেম নাথ বাজাজ) লিখেছিলেন: "মুসলিম জনসাধারণের দারিদ্র্য ভয়ানক। ... বেশিরভাগই ভূমিহীন শ্রমিক, অনুপস্থিত [হিন্দু] জমিদারদের জন্য দাস হিসেবে কাজ করে... সরকারী দুর্নীতির প্রায় পুরোটাই মুসলিম জনগণ বহন করে।"

হিন্দু শাসনের অধীনে, মুসলমানরা আইনী ব্যবস্থায় প্রচণ্ড কর এবং বৈষম্যের সম্মুখীন হয় এবং তাদের কোনো মজুরি ছাড়াই শ্রম দিতে বাধ্য করা হয়। রাজ্যের অবস্থার কারণে কাশ্মীর উপত্যকা থেকে ব্রিটিশ ভারতের পাঞ্জাবে জনগণের উল্লেখযোগ্য স্থানান্তর ঘটে। প্রায় এক শতাব্দী ধরে, হিন্দু অভিজাত শ্রেণী, একটি বিশাল এবং দরিদ্র মুসলিম কৃষকদের উপর শাসন করেছিল। দরিদ্রতার যাতাকলে নিস্পেষিত হয়ে তাদের আর অন্য কিছু ভাবার সুযোগ ছিল না। তাদের কোন শিক্ষা, অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা, এমনকি ১৯৩০ সাল পর্যন্ত মুসলিম কৃষকদের কোন রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব ছিল না।

১৯৪৭ ও ১৯৪৮

সম্পাদনা

রণবীর সিং-এর নাতি হরি সিং, ১৯২৫ সালে কাশ্মীরের সিংহাসনে আরোহণ করেন, তিনি ১৯৪৭ সালে উপমহাদেশের ব্রিটিশ শাসনের সমাপ্তি এবং পরবর্তীতে সদ্য স্বাধীন ভারত ও পাকিস্তানে বিভক্ত হওয়ার পরও শাসক ছিলেন। বার্টন স্টেইনের হিস্ট্রি অফ ইন্ডিয়া অনুসারে,

কাশ্মীর হায়দ্রাবাদের মত বড় বা পুরাতন স্বাধীন রাষ্ট্র ছিল না। ১৮৪৬ সালে শিখদের প্রথম পরাজয়ের পর ব্রিটিশদের পক্ষ থেকে একজন প্রাক্তন শাসক পরিবারকে রাজকীয় সম্মান সরূপ রাজ্য পুণঃবিন্যাস্ত করে এটি তৈরি করা হয়েছিল। হিমালয়ের পাদদেশের রাজ্যটি পাঞ্জাবের একটি জেলার মাধ্যমে ভারতের সাথে সংযুক্ত ছিল, কিন্তু এর জনসংখ্যা ছিল ৭৭ শতাংশ মুসলিম এবং এটি পাকিস্তানের সাথে একটি সীমানা সংযোগ ছিল। এই কারনে এটি অনুমান করা হয়েছিল যে ১৪-১৫ আগস্টে ব্রিটিশ শাসন শেষ হলে মহারাজা পাকিস্তানে যোগ দেবেন। যখন তিনি এটি করতে ইতস্তত করেন, তখন পাকিস্তান তার শাসককে বশ্যতা স্বীকার করতে ভয় দেখানোর জন্য গেরিলা আক্রমণ শুরু করে। পরিবর্তে মহারাজা মাউন্টব্যাটেনের কাছে সাহায্যের জন্য আবেদন করেন এবং গভর্নর-জেনারেল এই শর্তে সম্মত হন যে শাসক ভারতে যোগদান করবেন। ভারতীয় সৈন্যরা কাশ্মীরে প্রবেশ করে এবং রাজ্যের একটি ছোট অংশ ব্যতীত অন্য সব জায়গা থেকে পাকিস্তানি মদদপুষ্ট অনিয়মকারীদের তাড়িয়ে দেয়। এরপর জাতিসংঘকে আমন্ত্রণ জানানো হয় মধ্যস্থতা করার জন্য। জাতিসংঘ মিশন জোর দিয়েছিল যে কাশ্মীরিদের মতামত নিশ্চিত করতে হবে, অন্যদিকে ভারত জোর দিয়েছিল যে সমস্ত রাজ্য অনিয়মমুক্ত না হওয়া পর্যন্ত কোনও গণভোট ঘটতে পারে না।

১৯৪৮ সালের শেষের দিকে, জাতিসংঘের পৃষ্ঠপোষকতায় উভয় দেশ যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়। যেহেতু জাতিসংঘের দাবিকৃত গণভোট কখনোই পরিচালিত হয়নি, তাই ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি হতে থাকে এবং শেষ পর্যন্ত ১৯৬৫ এবং ১৯৯৯ সালে কাশ্মীর নিয়ে আরও দুটি যুদ্ধ সংঘটিত হয়।

বর্তমান অবস্থা ও রাজনৈতিক বিভাজন

সম্পাদনা

জম্মু ও কাশ্মীর এবং লাদাখ নিয়ে গঠিত জম্মু ও কাশ্মীরের প্রাক্তন রাজ্যের প্রায় অর্ধেক এলাকা ভারতের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, যেখানে পাকিস্তান এই অঞ্চলের এক তৃতীয়াংশ নিয়ন্ত্রণ করে, যা দুটি প্রদেশ, আজাদ কাশ্মীর এবং গিলগিট-বালতিস্তানে বিভক্ত। জম্মু ও কাশ্মীর এবং লাদাখ কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হিসাবে ভারত দ্বারা শাসিত হয়।

২০১৯ সালের ৫ আগস্ট, ভারত নিয়ন্ত্রিত জম্মু ও কাশ্মীর ভাগ করে জম্মু ও কাশ্মীর এবং লাদাখ এই দুটি রাজ্যে বিভক্ত করা হয়। এ সময় এর সীমিত স্বায়ত্তশাসন প্রত্যাহার করা হয়েছিল। এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার মতে:

যদিও ১৯৪৭ সালের বিভাজনের আগে কাশ্মীরে স্পষ্ট মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল এবং পাঞ্জাবের (পাকিস্তানে) মুসলিম-সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলের সাথে এর অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং ভৌগলিক সাদৃশ্য ছিল, কিন্তু রাজনৈতিক বিভাজনের ফলে অঞ্চলটি পৃথক হয়ে পড়ে। পাকিস্তানকে এমন ভূখণ্ড রেখে দেওয়া হয়েছিল যেটি মূলত মুসলিম চরিত্রে থাকলেও জনবহুল, তুলনামূলকভাবে দুর্গম এবং অর্থনৈতিকভাবে অনুন্নত ছিল। বৃহত্তম মুসলিম গোষ্ঠী, কাশ্মীর উপত্যকায় অবস্থিত এবং অনুমান করা হয়েছে যে সমগ্র অঞ্চলের অর্ধেকেরও বেশি জনসংখ্যা, ভারত-শাসিত অঞ্চলে রয়েছে, ঝিলম উপত্যকার একটি রাস্তা দ্বারা এর পূর্ববর্তী পথগুলো অবরুদ্ধ।

প্রাক্তন রাজ্য কাশ্মীরের পূর্বাঞ্চলও একটি সীমানা বিরোধে জড়িত যা ১৯ শতকের শেষের দিকে শুরু হয়েছিল এবং একবিংশ শতক পর্যন্ত অব্যাহত রয়েছে। যদিও কাশ্মীরের উত্তর সীমান্তে গ্রেট ব্রিটেন, আফগানিস্তান এবং রাশিয়ার মধ্যে কিছু সীমানা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, চীন কখনই এই চুক্তিগুলি গ্রহণ করেনি এবং ১৯৪৯ সালের কমিউনিস্ট বিপ্লবের পরে চীনের সরকারী অবস্থান পরিবর্তন হয়নি যা গণপ্রজাতন্ত্রী চীন প্রতিষ্ঠা করেছিল। ১৯৫০ এর দশকের মাঝামাঝি চীনা সেনাবাহিনী লাদাখের উত্তর-পূর্ব অংশে প্রবেশ করেছিল।

১৯৫৬-৫৭ সালের মধ্যে তারা জিনজিয়াং এবং পশ্চিম তিব্বতের মধ্যে আরও ভাল যোগাযোগের জন্য আকসাই চিন এলাকার মধ্য দিয়ে একটি সামরিক রাস্তা তৈরি করেছিল। এই রাস্তাটি ভারতের বিলম্বিত আবিষ্কারের ফলে দুই দেশের মধ্যে সীমান্ত সংঘর্ষ হয় যা ১৯৬২-এর চীন-ভারত যুদ্ধে পরিণত হয়।

অঞ্চলটি একটি আঞ্চলিক বিরোধে তিনটি দেশের মধ্যে বিভক্ত: পাকিস্তান উত্তর-পশ্চিম অংশ (উত্তর অঞ্চল এবং কাশ্মীর) নিয়ন্ত্রণ করে, ভারত কেন্দ্রীয় এবং দক্ষিণ অংশ (জম্মু ও কাশ্মীর) এবং লাদাখ নিয়ন্ত্রণ করে এবং গণপ্রজাতন্ত্রী চীন উত্তর-পূর্ব অংশ নিয়ন্ত্রণ করে ( আকসাই চিন এবং ট্রান্স-কারাকোরাম ট্র্যাক্ট)। ভারত সিয়াচেন হিমবাহের অধিকাংশ এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে, যার মধ্যে সালতোরো রিজ পাস রয়েছে, যেখানে পাকিস্তান সালতোরো রিজের ঠিক দক্ষিণ-পশ্চিমে নিম্নাঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করে। ভারত বিতর্কিত অঞ্চলের ১০১,৩৩৮ বর্গ কিমি (৩৯, ১২৭ বর্গ মাইল), পাকিস্তান ৮৫,৮৪৬ বর্গ কিমি (৩৩,১৪৫ বর্গ মাইল) নিয়ন্ত্রণ করে এবং গণপ্রজাতন্ত্রী চীন বাকী ৩৭,৫৫৫ বর্গ কিমি (১৪,৫০০ বর্গ মাইল) নিয়ন্ত্রণ করে।

জম্মু ও আজাদ কাশ্মীর পীর পঞ্জল পর্বতমালার দক্ষিণ ও পশ্চিমে অবস্থিত এবং যথাক্রমে ভারতীয় ও পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এগুলি জনবহুল অঞ্চল। গিলগিত-বালতিস্তান, পূর্বে উত্তর অঞ্চল হিসাবে পরিচিত ছিল, চরম উত্তরে অবস্থিত অঞ্চলগুলির একটি গ্রুপ, কারাকোরাম, পশ্চিম হিমালয়, পামির এবং হিন্দুকুশ পর্বতমালা দ্বারা সীমাবদ্ধ। গিলগিত শহরে এর প্রশাসনিক কেন্দ্রের সাথে, উত্তরাঞ্চল ৭২,৯৭১ বর্গ কিলোমিটার (২৮,১৭৪ বর্গ মাইল) এলাকা জুড়ে রয়েছে এবং আনুমানিক জনসংখ্যা ১০ লাখের কাছাকাছি। লাদাখ উত্তরে কুনলুন পর্বতমালা এবং দক্ষিণে প্রধান গ্রেট হিমালয়ের মধ্যে অবস্থিত। এই অঞ্চলের রাজধানী শহরগুলি হল লেহ এবং কার্গিল। এটি ভারতীয় প্রশাসনের অধীনে এবং ২০১৯ সাল পর্যন্ত জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের অংশ ছিল। এটি এই এলাকার সবচেয়ে কম জনবহুল অঞ্চলগুলির মধ্যে একটি এবং এখানে প্রধানত ইন্দো-আর্য এবং তিব্বতি বংশোদ্ভূত লোকেরা বসবাস করে। আকসাই চিন হল লবণের একটি সুবিশাল উচ্চ-উচ্চতার মরুভূমি যা ৫,০০০ মিটার (১৬,০০০ ফুট) পর্যন্ত উচ্চতায় পৌঁছায়। ভৌগলিকভাবে তিব্বত মালভূমির অংশ, আকসাই চিনকে সোডা সমভূমি বলা হয়। অঞ্চলটি প্রায় জনবসতিহীন, এবং কোন স্থায়ী বসতি নেই।

যদিও এই অঞ্চলগুলি তাদের নিজ নিজ দাবিদারদের দ্বারা শাসিত হয়, ভারত বা পাকিস্তান কেউই আনুষ্ঠানিকভাবে অন্যের দাবিকৃত অঞ্চলগুলির যোগদানকে স্বীকৃতি দেয়নি। ভারত দাবি করে যে, ১৯৬৩ সালে ট্রান্স-কারাকোরাম ট্র্যাক্টে পাকিস্তান কর্তৃক চীনকে "অর্পণ করা" এলাকা সহ, এটি তার ভূখণ্ডের একটি অংশ, যেখানে পাকিস্তান আকসাই চিন এবং ট্রান্স-কারাকোরাম ট্র্যাক্ট ব্যতীত সমগ্র অঞ্চলকে দাবি করে। দুই দেশ এই ভূখণ্ড নিয়ে বেশ কয়েকটি ঘোষিত যুদ্ধ করেছে। ১৯৪৭ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ আজকের রুক্ষ সীমানা প্রতিষ্ঠা করে, যেখানে পাকিস্তান প্রায় এক-তৃতীয়াংশ কাশ্মীর এবং ভারতের এক অর্ধেক অধিকার করে, জাতিসংঘ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত একটি বিভাজক নিয়ন্ত্রণ রেখা। ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের ফলে একটি অচলাবস্থা এবং জাতিসংঘ-আলোচনায় যুদ্ধবিরতি ঘটে।

কাশ্মীর অঞ্চলটি ৩২° এবং ৩৬° N অক্ষাংশ এবং ৭৪° এবং ৮০° E দ্রাঘিমাংশের মধ্যে অবস্থিত। এটির ক্ষেত্রফল ৬৮,০০০ বর্গ মাইল (১৮০,০০০ বর্গ কিমি)। এর উত্তর ও পূর্বে চীন (জিনজিয়াং এবং তিব্বত), উত্তর-পশ্চিমে আফগানিস্তান (ওয়াখান করিডোর), পশ্চিমে পাকিস্তান (খাইবার পাখতুনখোয়া এবং পাঞ্জাব) এবং দক্ষিণে ভারত (হিমাচল প্রদেশ এবং পাঞ্জাব)। কাশ্মীরের ভূ-সংস্থান বেশিরভাগই পাহাড়ি। এটি প্রধানত পশ্চিম হিমালয় দ্বারা শেষ প্রান্ত চিহ্নিত করা হয়। নাঙ্গা পর্বতে কাশ্মীরের পশ্চিম সীমানায় হিমালয় পর্বত সমাপ্ত হয়েছে। কাশ্মীরে সিন্ধু, জেহলুম এবং চেনাব নামে তিনটি নদী প্রবাহিত হয়েছে। এই নদী অববাহিকাগুলি অঞ্চলটিকে তিনটি উপত্যকায় বিভক্ত করেছে যা উচ্চ পর্বতশ্রেণী দ্বারা বিভক্ত। সিন্ধু উপত্যকা এই অঞ্চলের উত্তর এবং উত্তর-পূর্ব অংশ গঠন করে যার মধ্যে বাল্টিস্তান এবং লাদাখের খালি এবং জনশূন্য এলাকা রয়েছে। ঝিলাম উপত্যকার উপরের অংশটি উচ্চ পর্বতশ্রেণী দ্বারা বেষ্টিত কাশ্মীরের উপযুক্ত উপত্যকা গঠন করে। চেনাব উপত্যকা কাশ্মীর অঞ্চলের দক্ষিণ অংশ গঠন করে এবং এর দক্ষিণ দিকে বিচ্ছিন্ন পাহাড়। এতে জম্মু অঞ্চলের প্রায় পুরোটাই অন্তর্ভুক্ত। উচ্চ উচ্চতার হ্রদগুলি উচ্চ উচ্চতায় ঘন ঘন দেখা যায়। কাশ্মীরের উপত্যকায় নীচের দিকে অনেক মিষ্টি জলের হ্রদ এবং জলাভূমির বিশাল এলাকা রয়েছে যার মধ্যে রয়েছে শ্রীনগরের কাছে উলার লেক, ডাল লেক এবং হোকারসার।

উত্তর এবং উত্তর-পূর্বে, গ্রেট হিমালয় পেরিয়ে, অঞ্চলটি কারাকোরাম পর্বত পর্যন্ত বিস্তৃত। উত্তর-পশ্চিমে হিন্দুকুশ পর্বতমালা অবস্থিত। উপরের সিন্ধু নদী হিমালয়কে কারাকোরাম থেকে পৃথক করেছে। কারাকোরাম মেরু অঞ্চলের বাইরে বিশ্বের সবচেয়ে ভারী হিমবাহী অংশ। ৭৬ কিমি (৪৭ মাইল) সিয়াচেন হিমবাহ এবং ৬৩ কিমি (৩৯ মাইল) বিয়াফো হিমবাহ মেরু অঞ্চলের বাইরে বিশ্বের দ্বিতীয় এবং তৃতীয় দীর্ঘতম হিমবাহ হিসাবে স্থান পেয়েছে। কারাকোরামে K2 সহ চারটি আট-হাজার পর্বত শৃঙ্গ রয়েছে, যা বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ চূড়া ৮,৬১১ মিটার (২৮,২৫১ ফুট)।

সিন্ধু নদী প্রণালী কাশ্মীর অঞ্চলের অববাহিকা গঠন করে। নদীটি তিব্বত মালভূমি থেকে দক্ষিণ-পূর্ব কোণে লাদাখ অঞ্চলে প্রবেশ করে এবং সমগ্র লাদাখ ও গিলগিট-বালতিস্তানের মধ্য দিয়ে একটি গতিপথ চালানোর জন্য উত্তর-পশ্চিম দিকে প্রবাহিত হয়। এই অঞ্চলে উৎপন্ন প্রায় সব নদীই সিন্ধু নদী ব্যবস্থার অংশ। গ্রেট হিমালয় রেঞ্জের শেষ প্রান্তে পৌঁছানোর পর, সিন্ধু একটি কোণে মোড় নেয় এবং দক্ষিণ-পশ্চিমে পাঞ্জাব সমভূমিতে প্রবাহিত হয়। ঝিলাম এবং চেনাব নদীগুলিও এর মোটামুটি সমান্তরাল একটি গতিপথ অনুসরণ করে এবং পাকিস্তানের দক্ষিণ পাঞ্জাব সমভূমিতে সিন্ধু নদীর সাথে মিলিত হয়। কাশ্মীর অঞ্চলের ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য এক অংশ থেকে অন্য অংশে যথেষ্ট আলাদা। এই অঞ্চলের সর্বনিম্ন অংশটি দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে জম্মুর সমভূমি নিয়ে গঠিত, যা ১০০০ ফুট নীচের উচ্চতায় পাঞ্জাবের সমভূমিতে চলতে থাকে। পর্বতগুলি ২০০০ ফুট থেকে শুরু হয়, তারপরে "আউটার হিলস" এ ৩০০০-৪০০০ ফুট পর্যন্ত উত্থিত হয়, শৈলশিরা এবং দীর্ঘ সরু উপত্যকা সহ একটি রুক্ষ দেশ। ট্র্যাক্টের পরেই রয়েছে মধ্য পর্বতমালা যার উচ্চতা ৮০০০-১০,০০০ ফুট এবং বিস্তৃত উপত্যকা রয়েছে। এই পাহাড়গুলির সংলগ্ন উচ্চ হিমালয় পর্বতমালা (১৪,০০০-১৫,০০০ ফুট) রয়েছে যা সিন্ধু থেকে চেনাব এবং জেহলুমের নিষ্কাশনকে বিভক্ত করে। এই রেঞ্জের বাইরে লাদাখ এবং বাল্টিস্তানে ১৭,০০০-২২,০০০ ফুট উচ্চতার পার্বত্য দেশের বিস্তৃত অঞ্চল রয়েছে।

জলবায়ু

সম্পাদনা

উচ্চতার বিশাল তারতম্যের কারণে কাশ্মীরের প্রতিটি অঞ্চলের জন্য আলাদা জলবায়ু রয়েছে। তাপমাত্রা পাঞ্জাব গ্রীষ্মের গ্রীষ্মমণ্ডলীয় তাপ থেকে শুরু করে ঠান্ডার তীব্রতা পর্যন্ত পরিবর্তিত হয় যা পাহাড়ে চিরস্থায়ী তুষার ধরে রাখে। চেনাব উপত্যকার উপরের অংশগুলি বাদ দিয়ে জম্মু বিভাগে একটি আর্দ্র উপক্রান্তীয় জলবায়ু রয়েছে। কাশ্মীরের উপত্যকায় একটি মাঝারি জলবায়ু রয়েছে। আস্টোর উপত্যকা এবং গিলগিট-বালতিস্তানের কিছু অংশে আধা-তিব্বতীয় জলবায়ু রয়েছে। যদিও গিলগিট-বালতিস্তান এবং লাদাখের অন্যান্য অংশের মতো তিব্বতি জলবায়ু রয়েছে যা প্রায় বৃষ্টিহীন জলবায়ু হিসাবে বিবেচিত হয়। দক্ষিণ-পশ্চিম কাশ্মীর যা জম্মু প্রদেশের বেশিরভাগ অংশ এবং মুজাফফরাবাদ ভারতীয় বর্ষার নাগালের মধ্যে পড়ে। পীর পাঞ্জাল রেঞ্জ একটি কার্যকর প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করে এবং এই বর্ষাকালগুলিকে প্রধান কাশ্মীর উপত্যকা এবং হিমালয়ের ঢালে পৌঁছাতে বাধা দেয়। এই অঞ্চলের এই অঞ্চলগুলি আরব সাগরের বায়ু স্রোত থেকে তাদের বেশিরভাগ বৃষ্টিপাত গ্রহণ করে। হিমালয়ের ঢাল এবং পীর পাঞ্জাল মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত সর্বাধিক তুষার গলতে দেখা যায়। তুষার গলে যাওয়া এবং বৃষ্টিপাতের এই পরিবর্তনগুলি মূল উপত্যকার ধ্বংসাত্মক প্লাবনের দিকে পরিচালিত করেছে। রাজতরঙ্গিনী গ্রন্থে ১২ শতকের এই ধরনের একটি কাশ্মীরের বন্যার উদাহরণ লিপিবদ্ধ আছে। ১৯৩৫ সালের জুলাই মাসে একটি একক মেঘ বিস্ফোরণের ফলে উচ্চ জেহলুম নদীর স্তর ১১ ফুট বেড়ে যায়। ২০১৪ কাশ্মীরের বন্যা কাশ্মীরের শ্রীনগর শহরকে প্লাবিত করে এবং অন্যান্য শত শত গ্রাম তলিয়ে যায়।

উদ্ভিদ ও প্রাণীজগত

সম্পাদনা
 
কাশ্মীরের বনাঞ্চল

কিছু জাতীয় উদ্যান এবং সংরক্ষিত বনসহ কাশ্মীরের ২০,২৩০ বর্গ কিলোমিটার (৭,৮১০ বর্গ মাইল) রেকর্ডকৃত বনাঞ্চল রয়েছে। জলবায়ু এবং উচ্চতা অনুযায়ী বনের ধরন নির্ভর করে । কাশ্মীরের বন জম্মু ও মুজাফরাবাদের পাদদেশে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় বৃক্ষরাজী বন, কাশ্মীরের উপত্যকা জুড়ে নাতিশীতোষ্ণ বন এবং গিলগিট-বালতিস্তান এবং লাদাখে তৃণভূমি বনাঞ্চল অবস্থিত। উচ্চতার পার্থক্যের কারণে কাশ্মীর অঞ্চলে গাছের বৃদ্ধির চারটি সুনির্দিষ্ট অঞ্চল রয়েছে। ১৫০০ মিটার পর্যন্ত গ্রীষ্মমণ্ডলীয় বন, ফুলই (বাবলা মোডেস্তা) এবং জলপাই (ওলিয়া কাসপিড আতা) অঞ্চল হিসাবে পরিচিত। শোরিয়া রোবাস্টা, অ্যাকাসিয়া ক্যাটেচু, ডালবার্গিয়া সিসু, আলবিজিয়া লেবেক, গারুগা পিনাটা, টারমিনালিয়া বেলিরিকা এবং টি. টোমেনটোসা এবং পিনাস রক্সবুর্গির আধা-পর্ণমোচী প্রজাতিগুলি উচ্চ স্থানে জন্মে থাকে। (১৫০০-৩৫০০ মিটার) মধ্যবর্তী নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলকে চির পাইন (ফিন্স লংফিফোলিয়া) বলা হয়। এই অঞ্চলে ওক এবং রডোডেনড্রন প্রজাতির চিরসবুজ জাতীয় উদ্ভিদের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। ব্লু পাইন (ফিন্স এক্সেলসা) জোন সিডরাস ডিওদারা, অ্যাবিস পিন্ড্রো এবং পিসিয়া স্মিথিয়ানা ২,৮০০ এবং ৩,৫০০ মিটার উচ্চতায় দেখা যায়। বার্চ (বেতুলা ইউটিলিস) অঞ্চলে অ্যানিমোন, জেরানিয়াম, আইরিস, লয়েডিয়া, পোটেনটিলা এবং প্রিমুলার ভেষজ বংশ রয়েছে যা বারবেরিস, কোটোনেস্টার, জুনিপেরাস এবং রডোডেনড্রনের শুকনো বামন আলপাইন স্ক্রাবের সাথে মিশে আছে।

কাশ্মীরকে হিমালয়ের ঔষধি ও ভেষজ উদ্ভিদের সৌন্দর্যের স্থান হিসেবে উল্লেখ করা হয়। এই অঞ্চলের আলপাইন তৃণভূমিতে শত শত বিভিন্ন প্রজাতির বন্য ফুল রয়েছে। জাবারওয়ানে নির্মিত শ্রীনগরের বোটানিক্যাল গার্ডেন এবং টিউলিপ বাগানে যথাক্রমে ৩০০ প্রজাতির উদ্ভিদ এবং ৬০ জাতের টিউলিপ জন্মে। পরবর্তীতে এশিয়ার বৃহত্তম টিউলিপ গার্ডেন হিসেবে বিবেচিত হয়।

 
জানিস্কারি হল লাদাখে ঘোড়ার একটি প্রজাতি, যা কাশ্মীরি পরিবেশের সাথে অভিযোজিত

কাশ্মীর অঞ্চল বিরল প্রজাতির প্রাণীর আবাসস্থল, যার মধ্যে অনেকগুলি অভয়ারণ্য এবং সংরক্ষিত বনাঞ্চল হিসেবে রক্ষিত। এশিয়ায় সবচেয়ে বেশী কালো ভাল্লুকে বসবাস কাশ্মীরউপত্যকার দাচিগাম ন্যাশনাল পার্ক অঞ্চলে। গিলগিট-বালতিস্তানে দেওসাই জাতীয় উদ্যান পশ্চিম হিমালয় অঞ্চলে বাদামী ভাল্লুকের বৃহত্তম অঞ্চল মনোনীত করা হয়েছে। লাদাখের হেমিস জাতীয় উদ্যানে উচ্চ ঘনত্বে তুষার চিতাবাঘ পাওয়া যায়। এই অঞ্চলে কস্তুরী হরিণ, মারখোর, চিতা বিড়াল, জঙ্গলের বিড়াল, লাল শেয়াল, শেয়াল, হিমালয়ান নেকড়ে, লম্বা লেজযুক্ত নকুল, ভারতীয় সজারু, খরগোস, লঙ্গুর এবং হিমালয়ান বেজী রয়েছে। উপত্যকায় অন্তত ৭১১ প্রজাতির পাখি রেকর্ড করা হয়েছে যার অন্তত ৩১ টি রয়েছে বিশ্বব্যাপী বিপন্ন প্রজাতি।

জনসংখ্যা

সম্পাদনা

ব্রিটিশ ভারতীয় সাম্রাজ্যের ১৯০১ সালের আদমশুমারিতে, কাশ্মীর এবং জম্মু রাজ্যের জনসংখ্যা ছিল ২,৯০৫,৫৭৮ জন। এর মধ্যে ২,১৫৪,৬৯৫ (৭৪.১৬%) মুসলমান, ৬৮৯,০৭৩ (২৩.৭২%) হিন্দু, ২৫,৮২৮ (০.৮৯%) শিখ এবং ৩৫,০৪৭ (১.২১%) বৌদ্ধ (অর্থাৎ ৯৩৫ (০.০৩২%) অন্যান্য। হিন্দু জনসংখ্যা জম্মুতে বেশী ছিল, যেখানে এর পরিমান প্রায় ৬০%। কাশ্মীর উপত্যকায়, হিন্দু জনসংখ্যা প্রতি ১০,০০০ জনের মধ্যে ৫২৪ (অর্থাৎ ৫.২৪%) জন এবং লাদাখ ও গিলগিটের সীমান্তবর্তী ওয়াজারাতে প্রতি ১০,০০০ জনের মধ্যে (০.৯৪%) মাত্র ৯৪ জন।

একইভাবে ১৯০১ সালের আদমশুমারিতে কাশ্মীর উপত্যকায় মোট জনসংখ্যা ১,১৫৭,৩৯৪ নথিভুক্ত করা হয়েছিল, যার মধ্যে মুসলিম জনসংখ্যা ছিল ১,০৮৩,৭৬৬ বা ৯৩.৬% এবং হিন্দু জনসংখ্যা ৬,৬৪১। জম্মু প্রদেশের হিন্দুদের সংখ্যা ছিল ৬২৬,১৭৭ (বা ৯০.৮৭%), আদমশুমারিতে নথিভুক্ত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জাতিগুলি হল "ব্রাহ্মণ (১৮৬,০০০), রাজপুত (১৬৭,০০), খট্টরি (৪৮,০০০) এবং ঠক্কর (৯৩,০০০)।

ব্রিটিশ ভারতীয় সাম্রাজ্যের ১৯১১ সালের আদমশুমারিতে, কাশ্মীর এবং জম্মুর মোট জনসংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৩,১৫৮,১২৬। এর মধ্যে ২,৩৯৮,৩২০ (৭৫.৯৪%) মুসলমান, ৬৯৬,৮৩০ (২২.০৬%) হিন্দু, ৩১,৬৫৮ (১%) শিখ এবং ৩৬,৫১২ (১.১৬%) বৌদ্ধ।

১৯৪১ সালে ব্রিটিশ ভারতের শেষ আদমশুমারিতে, কাশ্মীর এবং জম্মুর মোট জনসংখ্যা (যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফলে, ১৯৩১ সালের আদমশুমারি থেকে অনুমান করা হয়েছিল) ছিল ৩,৯৪৫,০০০। এর মধ্যে, মোট মুসলিম জনসংখ্যা ছিল ২,৯৯৭,০০০ (৭৫.৯৭%), হিন্দু জনসংখ্যা ছিল ৮০৮,০০০ (২০.৪৮%), এবং শিখ ৫৫,০০০ (১.৩৯%)।

কাশ্মীরি পণ্ডিতরা, যারা কাশ্মীর উপত্যকার একমাত্র হিন্দু, সংখ্যায় ছিল প্রায় ৪%-৫%। ডোগরা শাসনামলে (১৮৪৬-১৯৪৭) তাদের ২০% কাশ্মীর উপত্যকা ছেড়ে অন্য অংশে চলে গিয়েছিল। এবং ১৯৫০ এর দশকে ভারত, ১৯৯০-এর দশকে কাশ্মীর বিদ্রোহের কারণে তারা সম্পূর্ণ দেশত্যাগ করে। বেশ কয়েকজন লেখকের মতে, সেই দশকে ১৪০,০০০ জন কাশ্মীরি পন্ডিত এর মধ্যে প্রায় ১০০,০০ জন উপত্যকা ত্যাগ করেছিলেন।

জম্মুর লোকেরা হিন্দি, পাঞ্জাবি এবং ডোগরিতে কথা বলে, কাশ্মীর উপত্যকা কাশ্মীরি ভাষায় কথা বলে এবং কম অধ্যুষিত লাদাখ তিব্বতি ও বাল্টিতে কথা বলে। জম্মু ও কাশ্মীর এবং লাদাখের ভারত-শাসিত কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের জনসংখ্যা হল ১২,৫৪১,৩০২ এবং আজাদ কাশ্মীরের পাকিস্তান-শাসিত অঞ্চলে লোকসংখ্যা হল ৪,০৪৫,৩৬৬, এবং গিলগিট-বালতিস্তান ১,৪৯২,৯২৪ জন।

নিয়ন্ত্রিত এলাকা জনসংখ্যা % মুসলিম % হিন্দু % বৌদ্ধ অন্যান্য %
ভারত কাশ্মীর উপত্যকা ~৪০ লাখ ৯৫% ৪%
জম্মু ~৩০ লাখ ৩০% ৬৬% ৪%
লাদাখ ~২ লাখ ৫০ হাজার ৪৬% ১২% ৪০% ২%
পাকিস্তান আজাদ কাশ্মীর ~৪০ লাখ ১০০%
গিলগিত-বালতিস্তান ~২০ লাখ ৯৯%
চীন আকসাই চীন
ট্রান্স-কারাকোরাম
  • বিবিসি ডেপথ রিপোর্টের পরিসংখ্যান অনুযায়ী।

কাশ্মীরের সংস্কৃতি

সম্পাদনা

কাশ্মীরের সংস্কৃতি ভারতীয় উপমহাদেশের উত্তরাঞ্চলে বসবাসকারী কাশ্মীরি জনগণের কথ্য ভাষা, লিখিত সাহিত্য, রন্ধনপ্রণালী, স্থাপত্য, ঐতিহ্য এবং ইতিহাস নিয়ে গঠিত। কাশ্মীরে ইসলামি আগ্রাসনের পর কাশ্মীরের সংস্কৃতি পারস্যের পাশাপাশি মধ্য এশিয়ার সংস্কৃতি দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল। কাশ্মীরি সংস্কৃতি হিন্দুধর্ম, বৌদ্ধ এবং পরবর্তীতে ইসলাম দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত।

আরও পড়ুন

সম্পাদনা

তথ্যসূত্র

সম্পাদনা
  1. "Kashmir: region, Indian subcontinent"এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৯ 
  2. "Kashmir territories profile" (ইংরেজি ভাষায়)। বিবিসি নিউজ। সংগ্রহের তারিখ ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৯ 
  3. "Kashmir profile—timeline" (ইংরেজি ভাষায়)। বিবিসি নিউজ। সংগ্রহের তারিখ ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৯ 
  4. Basham, A. L. (2005) The wonder that was India, Picador. Pp. 572. আইএসবিএন ০-৩৩০-৪৩৯০৯-X, p. 110.
  5. Imperial Gazetteer of India, volume 15. 1908. Oxford University Press, Oxford and London. pp. 93–95.
  6. আকবর, এম. জে. (১৯৯১), Kashmir, behind the vale, ভাইকিং, পৃষ্ঠা ৯ 
  7. রাইনা, মোহিনী কসবা (২০১৩), Kashur The Kashmiri Speaking People, ট্রাফোর্ড পাবলিশিং, পৃষ্ঠা ৩–, আইএসবিএন 978-1-4907-0165-3 
  8. স্নেডেন, ক্রিস্টোফার (২০১৫), Understanding Kashmir and Kashmiris, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় প্রেস, পৃষ্ঠা ২২–, আইএসবিএন 978-1-84904-342-7 
  9. "A Comparative Dictionary of the Indo-Aryan Languages"। Dsalsrv02.uchicago.edu। ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৯ 

বহিঃসংযোগ

সম্পাদনা