কালীপ্রসন্ন সিংহ
কালীপ্রসন্ন সিংহ (২৩ ফেব্রুয়ারি ১৮৪০ - ২৪ জুলাই ১৮৭০) ছিলেন একজন ভারতীয় বাঙালি লেখক ও সমাজসেবক। বাংলা সাহিত্যে তার দুই অমর অবদানসমূহের জন্য চিরস্মরনীয় হয়ে আছেন। সেগুলো হল, বৃহত্তম মহাকাব্য মহাভারতের বাংলা অনুবাদ এবং তার বই হুতোম প্যাঁচার নক্শা। ঊনবিংশ শতকের বাংলা-সাহিত্য আন্দোলনের তিনি অন্যতম একজন পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। মাত্র উনত্রিশ বছরের জীবনে তিনি সাহিত্য ও সমাজের উন্নয়নের জন্য অসংখ্য কাজ করেছেন। তিনি বিধবা বিবাহের একজন সমর্থক ছিলেন। বহু বিধবা দুখিনীর জীবন পরিবর্তন এর জন্য তিনি অকাতরে দান করেছেন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের প্রিয় ছাত্র ছিলেন তিনি।
কালীপ্রসন্ন সিংহ | |
---|---|
জন্ম | |
মৃত্যু | ২৪ জুলাই ১৮৭০ | (বয়স ২৯)
জাতীয়তা | ভারতীয় |
পেশা | সাহিত্যিক, সমাজসংস্কারক |
দাম্পত্য সঙ্গী | শরৎকুমারী দেবী |
পিতা-মাতা |
|
জন্ম ও পরিবার
সম্পাদনাযদিও কালীপ্রসন্ন সিংহের জন্মের সঠিক তারিখ তর্কসাপেক্ষ, কারণ ২৪শে ফেব্রুয়ারি ১৮৪০ তারিখে, কলকাতা কুরিয়ারে "২৩শে ফেব্রুয়ারি ১৮৪০ জোড়াসাঁকোর নন্দলাল সিংহের পুত্রের জন্ম অনুষ্ঠান পালন" শিরোনামে একটি সংবাদের প্রকাশ। তার জন্মের বছর সম্পর্কে বিভ্রান্তির উত্স এই যে, প্রথমে গবেষকরা তার মৃত্যুর ঘোষণার যে প্রমাণ পাওয়া যায় তাতে তিনি ১৮৭০ সালে ২৯ বছর বয়সে মারা যান বলে মনে করেন। যদিও, কলকাতা কুরিয়ারে প্রকাশিত খবর বিবেচনা করলে পরে, তার জন্ম তারিখ, ২৩শে ফেব্রুয়ারি ১৮৪০ এর কাছাকাছি কোথাও হবে বলে মনে হয়।
কালীপ্রসন্ন উত্তর কলকাতার জোড়াসাঁকোর বিখ্যাত "সিংহ" পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা বাবু নন্দলাল সিংহ ওরফে "সাতুসিংহ", মাতা ত্রৈলোক্যমোহিনী দেবী। প্রপিতামহ শান্তিরাম সিংহ (১৭২২ - ১৭৭৮) জোড়াসাঁকো সিংহ পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা। তাঁর প্রচুর অর্থসম্পত্তি তিনি নিজের দুই পুত্র প্রাণকৃষ্ণ (১৭৬৪ - ১৮১২) ও জয়কৃষ্ণর (১৭৭০ - ১৮২০) জন্যে রেখে গেছিলেন। জয়কৃষ্ণ দীর্ঘদিন নিঃসন্তান ছিলেন, অবশেষে তাঁর কনিষ্ঠা পত্নী শিবসুন্দরীর গর্ভে নন্দলালের জন্ম হয় ১৮১৯ সালে। ১৮১৭ সালে হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠার সময় যেই পাঁচ জন সবচেয়ে বেশি আর্থিক সাহায্য করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন বাবু জয়কৃষ্ণ সিংহ। তিনি হিন্দু কলেজের একজন পরিচালক ছিলেন। [১]
কালীপ্রসন্নের মাত্র ছয় বছর বয়সে পিতা নন্দলাল ওলাওঠায় (কলেরা) আক্রান্ত হয়ে মারা যান। সিংহ বাড়ির প্রতিবেশী ও বাবু প্রাণকৃষ্ণ সিংহের বন্ধু অভয়চরণ ঘোষের ছেলে, বাবু হরচন্দ্র ঘোষ, যিনি নিম্ন আদালতের বিচারক ছিলেন, নন্দলালের মৃত্যুর পর তাঁর অভিভাবক হিসাবে নিযুক্ত হন। পরবর্তীকালে জ্ঞাতিদের মধ্যে প্রচুর ধনসম্পত্তি নিয়ে বিবাদ শুরু হলে জ্ঞাতিদের বিরুদ্ধে মোকদ্দমা লড়তে হয়েছিল কালীপ্রসন্নের মা ত্রৈলোক্যমোহিনী দেবীকে - সেই ব্যাপারে কালীপ্রসন্ন হুতোম প্যাঁচার নকশা বইয়ে দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন।[২]
শিক্ষাজীবন
সম্পাদনাবর্তমানে প্রেসিডেন্সি কলেজ হিসাবে পরিচিত, তত্কালীন হিন্দু কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন কালীপ্রসন্ন। ১৮৫৭ সালে তিনি কলেজ ত্যাগ করেন। তিনি বাড়িতেই তার ইংরেজি, বাংলা ও সংস্কৃত শিক্ষা অব্যাহত রেখেছিলেন। তিনি মিস্টার ক্রিকপ্যাট্রিক (ইংরেজি: Mr.Kirkpatrick) নামক একজন ইউরোপীয় শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে তার ইংরেজির জ্ঞান উন্নত করেছিলেন। পরবর্তী জীবনে তিনি একজন লেখক, সম্পাদক, প্রকাশক, একজন লোকহিতৈষী, একজন সামাজিক কর্মী, এবং শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির একজন মহান পৃষ্ঠপোষক হিসাবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে তার অবদান রেখে গেছেন।
তার সংক্ষিপ্ত জীবনকালে, কালীপ্রসন্ন অবিশ্বাস্য বহুমুখী গুণাবলির একজন মানুষ ছিলেন। খুব অল্প বয়স থেকে তিনি অদ্ভুত স্মরণশক্তির অধিকারী ছিলেন, মাত্র একবার দেখলে কিংবা শুনলেই তিনি তা মনে রাখতে পারতেন। মাত্র তেরো বছর বয়সে ১৮৫৩ খ্রিষ্টাব্দে তার বাংলাভাষা চর্চার জন্য বিদ্যোৎসাহিনী সভা প্রতিষ্ঠা এই ক্ষমতার অদ্ভুত ক্ষমতার একটি সাক্ষ্য বহন করে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এই তরুণের অনেক বৃদ্ধ সহযোগীদের সঙ্গে একাত্মতা এবং এই ধরনের বিনোদনমূলক থিয়েটারের সংগঠন হিসাবে তাদের এই কাজে ব্রতী করতে পারা দেখে বিস্মিত হয়েছিলেন। হুতোম প্যাঁচার নক্শা হল তার সেই অমর সৃষ্টি যেখানে ঊনবিংশ শতকের কলকাতার বাবু সম্প্রদায়ের একটি পরিষ্কার চিত্র অঙ্কিত হয়েছে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, তার উপন্যাস সেই সময় (Those Days) লেখার সময়, প্রতীকী হিসাবে কালীপ্রসন্ন চরিত্রের পুনঃনির্মাণ করে নবীনকুমার নামে সমকালিক চরিত্রের অন্তর্ভুক্তি ঘটিয়েছেন।
বৈবাহিক জীবন
সম্পাদনাকালীপ্রসন্ন ১৮৫৪ সালে বাগবাজারের লোকনাথ বসুর কন্যা ভুবনমোহিনী দেবীকে বিবাহ করেন, কিন্তু কয়েক দিন পর তাঁর স্ত্রী বিয়োগ হয়। কিছুদিন পরে, কালীপ্রসন্ন রাজা প্রসন্ননারায়ণ দেবের পৌত্রী এবং চন্দ্রনাথ বসুর কন্যা শরত্কুমারী দেবীকে বিবাহ করেন।
অবদানসমূহ
সম্পাদনাবিদ্যোৎসাহিনী সভা ও বাংলা থিয়েটারে অবদান
সম্পাদনাসাহিত্যে তার অবদান ছাড়াও অন্য বিষয়ে, যেমন বাংলা থিয়েটারেও কালীপ্রসন্নের অপরিমেয় অবদান ছিল। মাত্র চোদ্দো বছর বয়সে তিনি বিদ্যোৎসাহিনী সভা (শিক্ষা গ্রহণে আগ্রহীদের জন্য একটি মঞ্চ) প্রতিষ্ঠা করেন। এটা সম্ভবত ১৮৫৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। কৃষ্ণদাস পাল, আচার্য কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্য, প্যারীচাঁদ মিত্র, এবং রাধানাথ শিকদারের মত বিশিষ্ট ভদ্রলোকেরা এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। বিদ্যোৎসাহিনী সভা প্রধানত হিন্দু থিয়েটার তুলে ধরার জন্য দায়বদ্ধ ছিল, এবং বিদ্যোৎসাহিনী মঞ্চ ১৮৫৭ সালে কালীপ্রসন্নের বসত বাড়িতে স্থাপিত হয়েছিল। এই দলের সদস্যরা ১৮৫৭ সালেই "শকুন্তলা" নামক থিয়েটারটি মঞ্চস্থ করেন। প্রত্যক্ষদর্শীদের মত অনুযায়ী "কলকাতার সিমলায় মঞ্চস্থ 'শকুন্তলা' থিয়েটারটি, যদিও একটি ব্যর্থ প্রয়াস ছিল, তবুও এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই, কারণ 'শকুন্তলা' থিয়েটারটি হল একটি সেরা শিল্পকর্ম, যেটার উপস্থাপনার জন্য প্রয়োজন বহুমুখী এবং সুসম্পূর্ণ প্রতিভা, যা তত্কালীন সময়ে এদেশে খুবই বিরল ছিল"। পরে কালিপ্রসন্ন "বেণীসংহার" থিয়েটারটি অভিনীত করেন, যা একটি উষ্ণ সাড়া পায় এবং সংবাদ প্রভাকর পত্রিকায় অভিনয়টি প্রশংসিত হয়। তরুণ কালীপ্রসন্ন, "ভানুমতী" নামক একটি মহিলা চরিত্রের ভূমিকায় অভিনয় করেন। পরে মাত্র ১৮৫৭ সালে, কালীপ্রসন্ন নিজই কালিদাসের সংস্কৃত রচনার উপর ভিত্তি করে "বিক্রমোর্বশী" নাটক লিখেছেন। কালীপ্রসন্ন রাজা পুরুরবার ভূমিকায় অভিনয় করেন যেখানে উমেশচন্দ্র ব্যানার্জ্জীর মত বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বও এই নাটকে অংশগ্রহণ করেছিলেন। অভিনেতা হিসেবে কালিপ্রসন্নের অভিনয়ক্ষমতা সহ নাটকটি দর্শকের কাছে অত্যন্ত সমাদৃত হয়। বিদ্যোৎসাহিনী সভার মাধ্যমে তিনি বাংলা কবিতায় ফাঁকা পদ্য (ইংরেজি: Blank verse) প্রবর্তনের জন্য মাইকেল মধুসূদন দত্তকে সমাদৃত করেন। কালীপ্রসন্ন একটি শংসাপত্র ও একটি রৌপ্য গোঁজ দিয়ে মাইকেল মধুসূদন দত্তকে পুরস্কার প্রদান করেছিলেন। এছাড়াও নীলদর্পণ নাটকের ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশ করবার জন্য রেভারেন্ড জেমস লং সাহেবকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছিল। এই সভার মুখপত্র বিদ্যোৎসাহিনী পত্রিকা ছাড়া আরো দু-একটি পত্রিকা কালীপ্রসন্ন সম্পাদনা করেছিলেন। পরবর্তীকালে কালীপ্রসন্ন, ১৮৫৪ সালে বাবু, ১৮৫৭ সালে বিক্রমোর্বশী, ১৮৫৮ সালে সাবিত্রী-সত্যবান এবং ১৮৫৯ সালে মালতী-মাধব -এর মত বেশ কিছু নাটক লেখেন। তিনি বিদ্যোৎসাহিনী থিয়েটার প্রতিষ্ঠিত ছাড়াও সেই থিয়েটারে নিজের রচিত বিক্রমোর্বশী নাটকে অভিনয়ও করেন।
প্রকাশনা
সম্পাদনাকালীপ্রসন্ন বিদ্যোৎসাহিনী পত্রিকা, পরিদর্শক,সারবত্ত্বা প্রকাশিকা ও বিভিধার্থ সংগ্রহ প্রভৃতি পত্রিকার মত পত্রিকাগুলির সম্পাদনা অথবা প্রকাশনা করেছিলেন। পরিদর্শক পত্রিকাটি ছিল একটি বাংলা দৈনিক যেটা শুরু করেছিলেন জগন্মোহন তর্কালঙ্কার এবং মদনগোপাল গোস্বামী। সংবাদপত্রটির উন্নতির জন্য, কালীপ্রসন্ন সংবাদপত্রের সম্পাদকের পদ গ্রহণ করেন। সংবাদপত্রটির মান সেই সময় এগিয়ে ছিল, এবং কৃষ্ণদাস পাল লিখেছিলেন, "তিনি একটি প্রথম শ্রেণীর স্বদেশীয় দৈনিক সংবাদপত্রও শুরু করলেন, যার মত আমরা এখনো দেখিনি"। সুপরিচিত স্থানীয় ভদ্রলোক বাবু রাজেন্দ্রলালের দ্বারা বিভিধার্থ সংগ্রহ প্রথম সম্পাদিত হয়েছিল। তার পরে পত্রিকাটি কালীপ্রসন্ন সিংের তত্ত্বাবধানে পুনর্জাগরিত হয়েছিল। ১৮৬২ সালে তার সবচেয়ে প্রশংসিত রচনা হুতোম প্যাঁচার নক্শা প্রকাশিত হয়েছিল। তিনি এই বইয়ে হুতোম প্যাঁচা ছদ্মনামে এক রসাত্মক পদ্ধতিতে তত্কালীন মধ্যবিত্ত সমাজের কার্যকলাপের সমালোচনা করেছিলেন। তৎকালীন কলকাতার আচার ব্যবহার, পালা-পার্বণ, সভা-সমিতি প্রভৃতি সামাজিক উৎসব এবং নানা ঘটনা হুতোম প্যাঁচার নক্শায় সরসভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। হুতোম প্যাঁচার নক্শা ছিল কথ্য ভাষায় লেখা প্রথম বাংলা বই। এই বইতে কোন কোন মান্য ব্যক্তির প্রতি কটাক্ষ করা হয়েছিল তাই এর প্রতিবাদে এইরকমের দু-একটি বইও লেখা হয়েছিল। তিনি তত্তবোধিনী পত্রিকা, সম্প্রকাশ, মুখার্জ্জীস ম্যাগাজিন, বেঙ্গলি এবং হিন্দু প্যাট্রিয়ট -এর মত পত্রিকাগুলিকেও আর্থিক সহায়তা প্রদান করেছিলেন।
মহাভারতের অনুবাদ
সম্পাদনাকালীপ্রসন্ন সিংহের সবথেকে বড় কীর্তি হল, তার সম্পাদনায় আঠারো পর্ব মহাভারত গদ্য আকারে বাংলায় অনুবাদ করা হয়েছে, যা এখনও ব্যাপকভাবে পঠিত এবং প্রকাশিত হয়। পুরো প্রকল্পটি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর দ্বারা পরিদর্শিত হয়। এই অনুবাদটি ১৮৫৮ থেকে ১৮৬৬ এর ভিতরে প্রকাশিত হয়েছিল। সমগ্র অনুবাদকরণ প্রক্রিয়াটি উত্তর কলকাতার বরানগরে অবস্থিত সারস্বতাশ্রম নামে একটি বাড়িতে সম্পন্ন হয়েছিল। কালীপ্রসন্ন বিনামূল্যে মহাভারত বিতরণ করেছিলেন। কালীপ্রসন্ন এই বিপুল খরচ বহন করতে তার বিভিন্ন মহল অর্থাৎ নিজস্ব মালিকানাধীন জমি বিক্রয় করে দিয়েছিলেন। তিনি তার রচিত মহাভারত অনুবাদটি মহারানী ভিক্টোরিয়া-কে উত্সর্গ করেছিলেন। তিনি পবিত্র হিন্দু ধর্মগ্রন্থ শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা-এর অনুবাদও করেছিলেন, যা তার মৃত্যুর পরে প্রকাশিত হয়।
তার অনুবাদ নাটক রচনার প্রেরণা বা তাগিদ এসেছিল রঙ্গমঞ্চ থেকে। সমাজের বৈষয়িক অবস্থার সঙ্গে রঙ্গমঞ্চের বিলুপ্তি বা পুনরাবির্ভাবের ইতিহাসটি মিলিয়ে দেখলেই তা বোঝা যায়।[৩]
সামাজিক অবদান
সম্পাদনা১৮৬১ সালে হরিশচন্দ্র মুখার্জীর মৃত্যুর পর, স্থানীয় ভারতীয়দের কল্যাণে নিবেদিত তার হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকা, অর্থের অভাব জনিত কারণে বিলুপ্তির সম্মুখীন ছিল। কালীপ্রসন্ন, যিনি হরিশচন্দ্র মুখার্জীকে অত্যন্ত সম্মান করতেন, পঞ্চাশ হাজার টাকা ব্যয়ে সেই পত্রিকাটির মালিকানা কিনে নেন, এবং পত্রিকা পরিচালনার জন্য শম্ভুচন্দ্র মুখোপাধ্যায়কে নিযুক্ত করেন। এছাড়াও কালিপ্রসন্ন, হরিশচন্দ্র মুখার্জীর স্মারক সংরক্ষণের জন্য পাঁচ হাজার টাকা প্রদান করেন, এবং স্মারক ভবনের উন্নয়নের জন্য একটি জমি সমর্পণ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন, তবে যেকোন কারণেই হোক অনান্যদের মধ্যে আগ্রহের অভাবে সেটি আর বাস্তবে পরিণত হয়নি। তিনি হরিশচন্দ্র মুখার্জীর মৃত্যুর পর হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকার সম্পাদকে বাঁচানোর জন্য সংরক্ষণ তহবিলে দান করেন হরিশ চন্দ্র মুখার্জীর বসত বাড়িটি নিলাম হওয়ার হাত থেকে রক্ষার উদ্দেশ্যে। তিনি বিধবা পুনর্বিবাহ প্রথার সমর্থক ছিলেন, এবং বিধবা পুনর্বিবাহ আইন প্রণয়নের পরে, এই প্রথা জনপ্রিয় করার জন্য, একটি বিধবা মেয়েকে বিয়ে করলে ১০০০ টাকা, এইরকম একটি পুরস্কার তিনি ঘোষণা করেন।
চার্চ মিশনারি সোসাইটির ধর্মযাজক, রেভারেন্ড জেমস লং, দীনবন্ধু মিত্রের লিখিত বিতর্কিত একটি নাটক নীল দর্পণ, যাতে স্থানীয় ভারতীয়দের প্রতি ব্রিটিশ নীল বিক্রেতাদের নৃশংসতার সমালোচনা করা হয়েছিল, ইংরেজিতে অনুবাদ করার জন্য বিদ্রোহী বলে অভিযুক্ত হয়েছিলেন, কালীপ্রসন্ন রেভারেন্ড লং-এর প্রদত্ত জরিমানার সম্পূর্ণ পরিমাণ অর্থ তাকে প্রদান করেছিলেন।
এছাড়াও ১৮৬৩ সালে কালীপ্রসন্ন সিংকে অবৈতনিক শাসক (ইংরেজি: Honorary Magistrate) ও ন্যায়পাল (ইংরেজি: Justice of Peace) হিসাবে নিয়োগ করা হয়। তিনি একদা কিছু সময়ের জন্য কলকাতার মুখ্য পুরশাসক (ইংরেজি: Chief Presidency Magistrate) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি কলকাতার পুরাধ্যক্ষ (ইংরেজি: Municipal Commissioner) নির্বাচিত হন। তার ব্যয়ের উপর কোন নিয়ন্ত্রণ ছিলনা এবং তার দানেরও কোন শেষ ছিলনা, যার ফলে কালীপ্রসন্ন তার জীবনের শেষ কয়েক দিন সময় বিপুল আর্থিক সঙ্কটের মধ্যে কাটিয়েছিলেন।
মৃত্যু
সম্পাদনাকালীপ্রসন্নের ঋণ বাড়তে থাকায় তিনি মাদকাসক্ত হয়ে পড়েন, যার ফলে তাঁর যকৃতের রোগ হয়। তিনি তাঁর বিশাল অবদান পিছনে ফেলে রেখে, মাত্র ৩০ বছর বয়সে ২৪শে জুলাই ১৮৭০ সালে ইহলোকের মায়া কাটিয়ে পরলোক গমন করেন।
কালীপ্রসন্নের অসংযত উপায়ে ব্যয় যার অধিকাংশ যদিও সমাজের কল্যাণে নিবেদিত ছিল, যার জন্য তার শেষ দিন তাকে মাশুল দিতে হয়েছিল। এটা বলা হয়ে থাকে যে এক মহাভারতের কতিপয় প্রতিলিপি বিতরণের জন্যেই ঐ সময়ে তাঁকে আড়াই লাখ টাকার বিপুল আর্থিক ধাক্কা মেনে নিতে হয়েছিল। এটি জানা সত্বেও যে জমিদার পরিবারের প্রধান আয়ের উত্স কৃষকদের দেওয়া রাজস্ব থেকে আসে, কালীপ্রসন্ন একজন জমিদার হয়েও, কৃষকদের মঙ্গলের জন্য এর বিরোধিতা করেছিলেন এবং বেশ কিছু কৃষককে রাজস্ব বোঝা থেকে মুক্তি প্রদান করেছিলেন। তার শেষের দিনগুলিতে, তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে কী বিশাল ঋণে পতিত হয়েছেন, এবং ফলস্বরূপ উড়িষ্যার বড় জমিদারি ও কলকাতার বেঙ্গল ক্লাব বিক্রি হয়ে যায়। তিনি বন্ধু ও আত্মীয়দের দ্বারাও প্রতারিত হন।
কালীপ্রসন্ন কোন সন্তান হওয়ার আগেই মারা যান। তাঁর মৃত্যুর পর, বাবু প্রাণকৃষ্ণ সিংহের প্রপৌত্র বলাইচাঁদের পুত্র বিজয়চন্দ্র সিংহ-কে শরৎকুমারী দেবী দত্তক নেন। বিজয়চন্দ্র সিংহ হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।
তার মৃত্যুর পর কৃষ্ণদাস পাল লিখেছেন, "কিন্তু তারুণ্যের অস্থির জলের তলদেশে উদারতার একটি রূপালি স্রোত বর্তমান ছিল, উদারতা, ভাল সহকারিতা এবং উচ্চ নজর, যা খুব কম লোকই প্রশংসা না করে থাকতে পারে। তার সমস্ত ত্রুটি সত্বেও কালিপ্রসন্ন ছিলেন একটি উজ্জ্বল চরিত্র এবং এমন একটি প্রদীপ্ত প্রতিশ্রুতিবান কর্মজীবনের এভাবে একটি আকস্মিক এবং দু:খজনক সমাপ্তির জন্য আমরা পর্যাপ্তরূপে আমাদের খেদ প্রকাশ করতে অপারগ"।
গ্রন্থতালিকা
সম্পাদনাকালীপ্রসন্ন সিংহ নিম্নলিখিত বইগুলি লিখেছিলেন:
- বাবুনাটক (১৮৫৪)
- বিক্রমোর্বশী নাটক (১৮৫৭)
- সাবিত্রী-সত্যবান নাটক (১৮৫৮)
- মালতী-মাধব নাটক (১৮৫৯)
- হিন্দু পেট্রিয়ট সম্পাদক মৃত হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের স্মরণার্থ কোনো বিশেষ চিহ্ন স্থাপন জন্য বঙ্গবাসিবর্গের প্রতি নিবেদন (১৮৬১)
- হুতোম প্যাঁচার নকশা (১৮৬১)
- পুরাণ সংগ্রহ বা মহাভারত (কালীপ্রসন্ন সিং) (মহাভারত অনুবাদ, ১৮৫৮-৬৬)
- বঙ্গেশ বিজয় (১৮৬৮)
- শ্রীমদ্ভাগবদ্গীতা (১৯০২)
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- বাঙ্গালা সাহিত্যের কথা - সুকুমার সেন - সপ্তম সংস্করণ