কবিচন্দ্র রামকৃষ্ণ রায়
রামকৃষ্ণ রায় হলেন মধ্যযুগে বাংলা ভাষার একজন স্মরণীয় কবি। বাংলা ভাষায় তিনিই প্রথম শিবায়ন কাব্য বা শিবমঙ্গল কাব্য রচনা করেন বলে মনে করা হয়। আনুমানিক ১৬২৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যেই তিনি 'শিবায়ন' কাব্য রচনা করেন। মতান্তরে রামকৃষ্ণ রায় রচিত শিবায়ন কাব্যেই বাংলা সাহিত্যে সাহিত্যিক গদ্যের প্রাচীনতম নিদর্শন রয়েছে বলে ধরা হয়।
কবিচন্দ্র রামকৃষ্ণ রায় | |
---|---|
জন্ম | ১৫৯০-১৫৯৫ খ্রিস্টাব্দ হাওড়া জেলার আমতা থানার অন্তর্গত রসপুর গ্রামে |
জাতীয়তা | ভারতীয় |
সময়কাল | পঞ্চদশ শতাব্দের শেষ পাদ থেকে ষোড়শ শতাব্দের প্রথম পাদ |
ধরন | মঙ্গলকাব্য, শিবায়ন কাব্য |
বিষয় | বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগ |
জন্ম ও প্রাথমিক শিক্ষা
সম্পাদনাতিনি অধুনা হাওড়া জেলার আমতা থানার অন্তর্গত রসপুর গ্রামের রায় পরিবারে ১৫৯০ থেকে ১৫৯৫ সালে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। যৌবনের পূর্বে অল্প বয়সেই রামকৃষ্ণ রায় মাতৃহারা হন। পিতা কৃষ্ণরাম রায় পুনরায় দার পরিগ্রহ করেননি। অল্প বয়সেই তিনি বিভিন্ন শাস্ত্রে সুপন্ডিত হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর উক্তিতেই পাওয়া যায়—
"শুনিল দর্শন ছয় বেদ শাস্ত্রে যত কয়
অষ্টাদশ পুরাণ ভারত।"
বাল্যকাল থেকেই তাঁর কবি প্রতিভা বিকশিত হতে থাকে এবং ক্রমে তিনি সম্মানজনক 'কবিচন্দ্র' উপাধি লাভ করেন।
বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত হওয়ার পরে তিনি শ্রী শ্রী ৺রাধাকান্ত দেবের পূজার প্রচলন করেন এবং তখন থেকেই শ্রী শ্রী রাধাকান্তদেব রসপুর রায়পরিবারের কুলদেবতা রূপে পূজিত হয়ে আসছেন।[১]
কবির বংশপরিচয়
সম্পাদনাশ্রী পাঁচুগোপাল রায় তাঁর বইতে রায় বংশের যে ইতিহাস লিপিবদ্ধ করেছেন, তা থেকে কবির বংশপরিচয় জানা যায়। তিনি পিতা কৃষ্ণরাম রায় এবং মাতা রাধার একমাত্র সন্তান ছিলেন। প্রসঙ্গত রামকৃষ্ণ রায় ছিলেন রসপুর রায় পরিবারের আদিপুরুষ যশশ্চন্দ্র রায়(যিনি ১৫৪৫ খ্রিস্টাব্দে রসপুর রায়পরিবারের দুর্গোৎসব প্রবর্তন করেন) এর পৌত্র। এছাড়াও রামকৃষ্ণ রায় স্বয়ং শিবায়নের অন্তিমে ঘোষণা করেছেন আত্মপরিচয়—
"পূর্বকবি পন্ডিতে করিয়ে পরণতি
সভাসদ পন্ডিতেরে আমার ভকতি।
পিতামহ রায় যশশ্চন্দ্র মহামতি
তাঁর পদাম্বুজে মোর অশেষ প্রণতি।
পিতামহী বন্দিলাম নাম নারায়ণী
সরস্বতী বন্দিলাম তাঁহার সতীনি।
মাতামহ বন্দিলাম নাম সূর্য মিত্র,
তেওজ কুলীন তেহ, পবিত্র চরিত্র।
পিতা কৃষ্ণ রায় বন্দ্যো সর্বশাস্ত্রে ধীর
যাহার প্রসাদে এই মনুষ্য শরীর।
মাতা রাধাদাসীর চরণে দন্ডবৎ
যাঁর গর্ভবাস হইতে দেখিল জগৎ।
কায়স্থ দক্ষিণ রাঢ়ী বংশেতে উৎপত্তি
গোত্র কাশ্যপ আমার দেবতা প্রকৃতি।
মিরাশ বন্দিনু বাস্তু রসপুর দেশ
এতদূরে ভাইরে বন্দনা হইল শেষ।
রামকৃষ্ণ দাস গান শিবের মঙ্গল,
ভক্তজনে প্রভু তুমি করিবে কুশল।
গায়ন বায়ন যেবা শুনে এই গীত,
সভাকারে প্রভু তুমি হইবে সুপ্রীত।"[২]
তাঁর সময় থেকেই রসপুর রায় পরিবারের দুর্গাপূজায় সকল প্রকার পশুবলির প্রচলন বন্ধ হয়।
রামকৃষ্ণ রায়ের প্রপৌত্র বাসুদেব রায়ও বিশিষ্ট কবিপ্রতিভার অধিকারী ছিলেন। তাঁর রচিত একটি সরস্বতীবন্দনা বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ এ রক্ষিত আছে(৯০০ সং বাঙ্গালা পুঁথি, তিন পত্রে সম্পূর্ণ)। এর অন্তিমভাগে কবির পরিচয় পাওয়া যায়।
শিবায়ন রচনা
সম্পাদনাকবিচন্দ্র রামকৃষ্ণ রায়কে বাংলা ভাষায় প্রথম শিবায়ন কাব্য-রচয়িতা বলে মনে করা হয়। আনুমানিক ১৬২৫ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ তিনি শিবায়ন কাব্য রচনা সম্পন্ন করেন। শিবায়ন কাব্য রচনার পূর্বেই তাঁর বিবাহ সম্পন্ন হয় এবং কাব্য রচনাকালে জগন্নাথ ও বলরাম নামে তাঁর দুইটি পুত্রসন্তান জন্মগ্রহণ করেন। শিবায়নের ভনিতায় পাওয়া যায়
"কবিচন্দ্র রচিলা সঙ্গীত শিবায়ন
ভক্ত নায়কে কৃপা কর পঞ্চানন।।"
[পালা-১, মহাবিষ্ণুর উৎপত্তি (২১)]
এই ভনিতাটির ভাব এক রেখে শিবায়ন কাব্যের অন্তর্ভুক্ত অন্য পালাগুলিতে লিখেছেন—
"কবিচন্দ্র বিরচিত গীত শিবায়ন।
ভক্ত সেবকে দয়া কর পঞ্চানন॥"
[পালা-২২, দুর্গার দুঃখ (২); পালা-২৬, শ্রীকৃষ্ণের লীলা, কন্দর্পের জন্ম; পালা-২৬, শিবের ক্রোধশান্তি]
শিবায়ন কাব্য ২৬ টি পালায় বিভক্ত। এই কাব্যে কিছু গদ্যের নিদর্শন পাওয়া যায় ‘বচনিকা’ শীর্ষক রচনাগুলোয়। যেমন, ‘ভাই রে নারদের পরিহাসে, মেনকা রোদন করিতেছেন, এমত সময়ে কেমন স্ত্রীলিঙ্গ দেবতা সকল আসিতেছেন অবধান করহ।৷’। পণ্ডিতদের অনুমান, ‘সম্ভবত বাঙলা সাহিত্যে সাহিত্যিক গদ্যের এটিই প্রাচীনতম নিদর্শন’। একাধিকবার "আধান করহ", "অবদান করহ" প্রভৃতির ব্যবহার হয়েছে যা আধুনিক গদ্যের রীতিকে স্মরণ করায়। যদিও বাংলা গদ্যের প্রাচীনতম নিদর্শন ধরা হয় কোচবিহার রাজ নরনারায়ণের লেখা চিঠিকে। ১৫৫৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি অহোমরাজ চুকামফা স্বর্গদেবকে চিঠিটি লিখেছিলেন।[৩] [৪][৫]
ধর্মমতের দিক থেকেও কবিচন্দ্র পুরাণের আদর্শকে অনুসরণ করে হরিহরের অভেদত্ব প্রমাণ করেন, যা তাঁর উদার ধর্মবিশ্বাসের সাক্ষ্য বহন করে।[৬]
শিবায়ন পুঁথি
সম্পাদনাশিবায়নের ভূমিকায় সম্পাদকদ্বয় লিখছেন বাংলা ১৩০৬ সনের পূর্বে বিশ্বকোষ কার্যালয়ে রামকৃষ্ণ রায়ের শিবায়নের পুঁথি প্রথম সংগৃহীত হয়। শিবায়নের একটি পুঁথি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংরক্ষিত আছে। একটি অনুলিপি শ্রী পাঁচুগোপাল রায়ের কাছে আছে। কোনো তৃতীয় পুঁথির উল্লেখ শিবায়নের সম্পাদকদ্বয় না করলেও শ্রী পাঁচুগোপাল রায় বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের অধীনে তৃতীয় একটি পুঁথি সংরক্ষিত আছে বলে উল্লেখ করেছেন। বিভিন্ন পুঁথির পাঠান্তর প্রসঙ্গে সম্পাদকদ্বয় শিবায়ন ভূমিকায়(বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ থেকে প্রকাশিত) লিখেছেন, "এক সময়ে ইহা(রামকৃষ্ণ রায় রচিত শিবায়ন) সমুচিত প্রচার লাভ করিয়াছিল- নতুবা এত পাঠভেদের সৃষ্টি হইতে পারে না।" একাধিক সামাজিক ও রাজনৈতিক কারণে আঠারোশ' শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে রামকৃষ্ণের শিবায়নের প্রচার ক্রমে কিছুটা কমে আসে। বর্তমানে বাংলা সাহিত্যের একদা উজ্জ্বল এই জ্যোতিষ্কের স্মরণে তৈরি হয়েছে 'রামকৃষ্ণ কবিচন্দ্র রায়' স্মৃতিরক্ষা কমিটি।[৭]
শ্রী শ্রী রাধাকান্ত দেব ও কবির জীবনের অন্তিমভাগ
সম্পাদনাবৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষাগ্রহণের পরে রামকৃষ্ণ রায়, শ্রী শ্রী রাধাকান্ত নামে যুগল বিগ্রহ স্থাপন করেন ও তাঁর সেবায় নিজেকে সমর্পণ করেন। ক্রমে এই বিগ্রহের নানারূপ মাহাত্ম্য কাহিনী লোকমুখে ছড়িয়ে পড়ে। এই সময় দক্ষিণ রাঢ়ের বর্ধমান অঞ্চলের রাজা কৃষ্ণরাম রায় ১০৯০ বঙ্গাব্দ নাগাদ রাজা চৈতন্যসিংহ শাসিত বালিয়া পরগণা আক্রমন করেন, যার থেকে রসপুরের দূরত্ব সরলরেখায় মাত্র আট মাইল মতো। বালিয়া আক্রমনের পরেই রসপুরে রামকৃষ্ণ রায়ের বসতবাড়ি আক্রান্ত হয় এবং রাজা কৃষ্ণরাম এসময় বলপূর্বক কবিচন্দ্রের অত্যন্ত প্রিয় এই রাধাকান্ত বিগ্রহ অধিকার করে সঙ্গে নিয়ে যান। কথিত আছে বৃদ্ধ বয়সে এই শোকের আঘাতে রামকৃষ্ণ রায় মুহ্যমান হয়ে পড়েন এবং শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
তাঁর পুত্রেরা তাঁর আদ্যশ্রাদ্ধের পূর্বে রাজা কৃষ্ণরামের কাছে বিগ্রহ ফিরিয়ে আনার আর্জি নিয়ে উপস্থিত হলে রাজা কৃষ্ণরাম নতুন বিগ্রহ স্থাপন করার উপদেশ দেন ও দেবসেবার জন্য ১০৯১ সালের ১১ই বৈশাখ ৮৫ বিঘা নিষ্কর জমি দান করেন। এর থেকে প্রমাণিত হয় ১০৯০ বঙ্গাব্দের চৈত্র মাসের শেষে (অর্থাৎ ১৬৮৪ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে) কবিচন্দ্র রামকৃষ্ণ রায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন। বর্তমানে একটি ট্রাস্টি বোর্ডের মাধ্যমে শ্রী শ্রী রাধাকান্ত জীউ এর যাবতীয় পূজার্চনা পরিচালিত হয়।
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ রামকৃষ্ণ রায় কবিচন্দ্র ও রসপুর রায়বংশের ইতিকথা// শ্রী পাঁচুগোপাল রায়
- ↑ শিবায়ন- রামকৃষ্ণ কবিচন্দ্র বিরচিত- সম্পাদনা- শ্ৰী দীনেশচন্দ্র ভট্টাচার্য ও শ্ৰী আশুতোষ ভট্টাচার্য, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ কর্তৃক প্রকাশিত( প্রথম প্রকাশ: আষাঢ়, ১৩৬৩ বঙ্গাব্দ)
- ↑ "সাহিত্যিক গদ্যের প্ৰথম লেখকের খোঁজে"।-দীপক দাস
- ↑ সমগ্র বাংলা সাহিত্যের পরিচয়’— শ্রী পরেশচন্দ্র ভট্টাচার্য
- ↑ পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি’- বিনয় ঘোষ
- ↑ "রামকৃষ্ণ রায় এর কবি প্রতিভা আলোচনা করো প্রশ্নোত্তর"। BanglaStudy.Org।
- ↑ "আনন্দবাজার পত্রিকা - দক্ষিণবঙ্গ"। archives.anandabazar.com। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-০৭-২৫।