ওকাকুরা কাকুজো (২৬ ডিসেম্বর, ১৮৬২ - ২ সেপ্টেম্বর, ১৯১৩) হলেন জাপানের প্রখ্যাত একজন শিল্পীটোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা লাভ করে দর্শনইংরাজী সাহিত্যে গভীর জ্ঞান অর্জন করেন এবং ওই বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই তিনি বিশেষভাবে সম্মানিত হন। তিনি ওকাকুরা তেনসিন ( 岡倉 天心 ) নামেও পরিচিত ছিলেন । জাপানের কলাশিল্পে অসামান্য অবদানের জন্য এই শিল্পশাস্ত্রী চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। বহির্বিশ্বে তিনি স্মরণীয় হয়ে আছেন তার কালজয়ী পুস্তক দি বুক অফ টি-এর জন্য।[]

শিল্পশাস্ত্রী ওকাকুরা কাকুজোর ১৮৯৮ সালের একটি ছবি

জীবনকাল

সম্পাদনা

ছাত্রাবস্থায় তিনি মনীষী ফেনলোসার সঙ্গী হয়ে জাপানের বহু মঠ মন্দির ভ্রমণ করেন এবং সেখানে রক্ষিত প্রাচীন শিল্পনিদর্শনগুলি দেখে শিল্পশাস্ত্রচর্চায় বিপুল উৎসাহ লাভ করেন। ১৮৮৬ সালে প্রথমে তিনি জাপান সরকারের শিক্ষামন্ত্রণালয়ের সচিব নিযুক্ত হন ; পরে সরকারি আর্ট কমিশনের সদস্যরূপে ইউরোপআমেরিকা পরিভ্রমণ করেন। পরবর্তীকালে তিনি ভারতবর্ষে এসে বিভিন্ন প্রাচীন মন্দির ও গুহাচিত্র পরিদর্শন করেন। এর ফলে তিনি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য উভয় শিল্পধারাতে অভিজ্ঞ হয়ে ওঠেন। দেশে ফিরে তিনি সরকারি শিল্প মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন। এর কয়েক বছর পর জাপানের পাশ্চাত্যমুখী গতির ফলে সরকারের সাথে ওকাকুরার মনোমালিন্য সৃষ্টি হয় এবং তারই অনিবার্য কারণে তিনি অধ্যক্ষের আসন থেকে পদত্যাগ করেন। অতঃপর তিনি বিশিষ্ট শিল্পীদের সহযোগিতায় টোকিও নগরীর উপান্তে নিপ্পঙ বিজিতসুইঙ নামে কলাভবন প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯০৬ সালে তিনি বোষ্টন মিউজিয়াম অফ ফাইন আর্টসের উপদেষ্টা নিযুক্ত হন।[]

বাংলা সংস্কৃতিতে ওকাকুরা

সম্পাদনা

ভারতে বিশেষ করে বাংলাদেশে বিংশ শতকের গোড়ার দিকে যে নব উন্মেষের সূচনা হয়েছিলো সেখানে ওকাকুরা কাকুজোর অবদান অনস্বীকার্য। জাপানে একটি ধর্মমহাসম্মেলনের আয়োজনের কথা ভেবে তিনি আনুমানিক ১৯০১ সালের শেষে ভারতে এসে কিছুকাল অতিবাহিত করেন। এই সময় ভগিনী নিবেদিতার মাধ্যমে তার বাংলার বেশ কিছু মনীষী ও দেশপ্রেমিকের সাথে ঘনিষ্ঠতা ঘটে। এখানে তিনি স্বামী বিবেকান্দের সাথে সাক্ষাত করেন এবং স্বামী বিবেকানন্দের দর্শণ ও নন্দন তত্ত্বের অদ্বৈবাদ নন্দন তত্ত্বে আগ্রহী হন। পরবর্তীতে স্বামীজিকে তিনি জাপানে নিয়ে আসেন এবং শিকাগো শহরের মত একটা ধর্ম সম্মেলন করতে চেয়েছিলেন।ওকাকুরার প্রেরণায় বাংলায় বিপ্লব আন্দোলনের সূচনা হয়। ১৯২৯ সালে রবীন্দ্রনাথ জাপান ভ্রমণকালে একটি বক্তৃতায় বাংলার যুবসমাজের উদবোধনে ওকাকুরার ভূমিকার ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন । ওকাকুরার যে বাণী সেদিন যুবসমাজের মনে মন্ত্রের মতো কাজ করেছিল' তা তার 'দি আইডিয়ালস্ অফ দি ইস্ট'-গ্রন্থের প্রথম কথা 'এশিয়া ইজ ওয়ান'-কথার মধ্যে ধরা আছে । এশিয়ার এই ঐক্যের বাণী সেদিন বাঙালি মানসে স্বদেশের প্রতি প্রেম ও ভালোবাসার এক অখণ্ড ভাবনার জন্ম দিয়েছিলো।[] বাংলার বিপ্লববাদকে যেমন ওকাকুরা প্রাণ দিয়েছিলেন তেমনি বাংলার চিত্রকলার নবজাগরণের নায়কদের চিন্তাভাবনাকেও তার ভাবধারা পরিপুষ্টি দান করেছিলো। ওকাকুরার উদ্যোগে জাপানের টাইকান প্রমুখ বিখ্যাত কয়েকজন শিল্পী এদেশে এসে চিত্রচর্চা শুরু করেন ; এইভাবে জাপানের শিল্পশৈলীর সাথে ভারতীয় বাঙালি শিল্পীর পরিচয় ঘটে। আরও পরে জাপান ও চিনের সাথে রবীন্দ্রনাথের যে শ্রদ্ধার যোগ স্থাপিত হয়েছিলো এবং কবিগুরুর জীবন ও কর্মে তার বিশেষ ছাপ পড়েছিলো তার সূত্রপাতও ঘটেছিলো ওকাকুরার পরিচয়ের মাধ্যমে। বহুক্ষেত্রেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তা অকপটে স্বীকারও করেছেন। সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথেও ওকাকুরার পরিচয় অন্তরের যোগে পরিণত হয়েছিলো। আর এইসমস্ত সম্পর্কের টানে তিনি একাধিকবার ভারত ভ্রমণে এসেছেন।

ওকাকুরার সাহিত্য কীর্তি

সম্পাদনা
  • 'দি আইডিয়ালস অফ দি ইস্টা' ১৯০৩
  • 'দি অ্যাওয়েকেনিং অফ জাপান' ১৯০৫
  • 'দি বুক অফ টি' ১৯০৬
  • 'দি হার্ট অফ হেভেন' ১৯২২, (অপ্রকাশিত রচনাবলী)

তথ্যসূত্র

সম্পাদনা
  1. Ambassador of Tea Culture to the West' (biography of Okakura), Andrew Forbes and David Henley, The Illustrated Book of Tea (Chiang Mai: Cognoscenti Books, 2012).
  2. Rupert Richard Arrowsmith, "The Transcultural Roots of Modernism: Imagist Poetry, Japanese Visual Culture, and the Western Museum System", Modernism/modernity Volume
  3. 'স্বর্গগত শ্রীমদ ওকাকুরা', ভারতী, কার্তিক, ১৩২০ বঙ্গাব্দ - অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর