এভারিস্ত গালোয়া

ফরাসি গণিতবিদ

এভারিস্ত গালোয়া[] (ফরাসি ভাষায়: Évariste Galois) (অক্টোবর ২৫, ১৮১১ - মে ৩১, ১৮৩২) একজন ফরাসি গণিতবিদ। তিনি গ্রুপ থিওরীর প্রবর্তন করেন। তিনি একটি মাত্র চিঠিতে (কোশির কাছে লেখা) প্রমাণ করেন যে, পঞ্চম বা তার বেশি মাত্রার বহুপদীর সাধারণ সমাধান মূলকের মাধ্যমে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। আবিষ্কারটি যতটা না গুরুত্বপূর্ণ, তার থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে তিনি যে উপায়ে প্রমাণ করেন সেই উপায়টি।

এভারিস্ত গ্যালোয়া
জন্ম(১৮১১-১০-২৫)২৫ অক্টোবর ১৮১১
মৃত্যু৩১ মে ১৮৩২(1832-05-31) (বয়স ২০)
জাতীয়তাFrench
পরিচিতির কারণWork on the theory of equations and Abelian integrals
বৈজ্ঞানিক কর্মজীবন
কর্মক্ষেত্রগণিত
স্বাক্ষর

গ্যালোয়ার জন্ম ২৫ অক্টোবর, ১৮১১। তাঁর বয়স যখন ১৪ তখন প্রথমবারের মত পরিচয় ঘটে গণিতের সাথে। যেদিন প্রথম ক্লাসে গণিত পড়ানো হয়, তাঁর মধ্যে যেন একটা বিপর্যয় ঘটে যায়। তিনি গণিতে এতই মজে ছিলেন যে, অন্য সব কিছু পড়া একেবারে ছেড়ে দিলেন। সব কিছুতে খুব খারাপ করতে লাগলেন। আগে তেমন খারাপ ছাত্র ছিলেন না, ল্যাটিন ভাষায় দক্ষতার জন্য পুরস্কারও পেয়েছিলেন, কিন্তু এখন অন্য বিষয়গুলোতে তাঁর পাশ করা বেশ কঠিন হয়ে গেল। গণিত চর্চায় এতই এগিয়েছিলেন যে তাঁর হঠাৎ মনে হওয়া শুরু হলো, গণিতে তাকে শেখানোর মতো স্কুলের শিক্ষকদের কাছে আর অবশিষ্ট কিছুই নেই। ফলে নিজেই নিজের মত বই কিনে গণিত চর্চা শুরু করলেন। কিন্তু এইবার ভিন্ন সমস্যা শুরু হল। গ্যালোয়া যেই পরিমাণে গণিত বুঝেন, সেই পরিমাণ গণিত আসলে তাঁর শিক্ষকরাও বুঝতেন না। ফলে পরীক্ষার খাতায় গ্যালোয়া যা উত্তর করেন তাঁর কিছুই তাঁদের বোধগম্য হয় না। এবার গ্যালোয়া গণিতেও খারাপ করা শুরু করলেন।

১৮২৮ সালে তিনি École Polytechnique নামক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিলেন। এটা ছিলো গণিতের জন্য তৎকালীন ফ্রান্সের সবচেয়ে ভালো প্রতিষ্ঠান। এরই মধ্যে তিনি পড়ে ফেলেছেন Adrien Marie Legendre' এর Éléments de Géométrie, Joseph Louis Lagrange এর Réflexions sur la résolution algébrique des équations (এটি পরবর্তিতে তাঁকে ইকুয়েশন থিওরীতে কাজ করতে আগ্রহী করে তোলে), Leçons sur le calcul des fonctions ইত্যাদি। কিন্তু মৌখিক পরীক্ষায় গিয়ে তিনি পরীক্ষকদের কোনো প্রশ্নের উত্তরেই সন্তুষ্ট করতে পারলেন না। আসলে তিনি তাঁদেরকে উত্তর এমন অল্প কথায় ব্যাখ্যা ছাড়া দিয়েছিলেন যে কেউ তা বুঝতে পারেনি। ফলে তিনি École Polytechnique তে ভর্তি হতে ব্যর্থ হন। পরে সেই বছর তিনি অপেক্ষাকৃত নিম্ন র‍্যাংকিং এর বিশ্ববিদ্যালয় École préparatoire তে ভর্তি হন।

স্বপ্নের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে ব্যর্থ গ্যালোয়া তাঁর সমস্ত জিদ যেন ঢেলে দেন গণিতের উপরে। তুমুল উৎসাহে মেতে ওঠেন ত্রিঘাত, চতুর্ঘাত আর পঞ্চঘাত সমীকরনে। ১৮২৯ সালে তাঁর প্রথম গবেষণাপত্র প্রকাশ হয় Annales de mathematiques এ continuous fraction এর উপরে। অনেক পরিশ্রম করে ২টি রিসার্চ পেপার তৈরি করে জমা দেন Academy of Sciences এ। তখন Academy of Sciences এর প্রধান ছিলেন বিখ্যাত গণিতবিদ Augustin Louis Cauchy। তিনি পেপার দুটির নিজেই সুপারিশ করেছিলেন, একই সাথে তিনি গ্যালোয়ার কাছে পেপার দুটি ফেরত পাঠান পুনর্বিন্যাস ও ব্যাখ্যা করে লেখার জন্য। বছর ঘুরতেই (১৮২৯) রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে গ্যালোয়ার বাবা আত্মহত্যা করেন। পিতার মৃতদেহ সৎকার করে গ্যালোয়া প্যারিস ফিরলেন, অসমাপ্ত কাজ শেষ করে তার পেপার দুটি জমা দিলেন একাডেমির সেক্রেটারি স্যার জসেফ ফুরিয়ারে কাছে। কিন্তু সেবার গ্যালোয়া পুরস্কার পান নি। পুরস্কার ঘোষণার কিছু দিন আগে ফুরিয়ার মারা যান এবং তার পেপার যে জমা হয়েছে এমন কোন ডকুমেন্টের অস্তিত্বই ছিল না। ফলে রাজনৈতিক কারণে গ্যালোয়ার পেপার গায়েব হয়েছে বলে তাঁর সন্দেহ হয়। এই সন্দেহ পুরোপুরি বাস্তবে প্রমাণিত হলো যখন অযৌক্তিক ও অবোধ্য এর খোড়া যুক্তি দেখিয়ে একাডেমি অফ সায়েন্স তার একাধিক গবেষণাপত্র ফেরত পাঠায় (১৮৩০)। সে বছর গ্যালোয়া মোট ৩টি গবেষণা পত্র প্রকাশ করেন, যার মধ্যে একটি বিখ্যাত Galois theory এর ভিত্তি গড়ে দেয়, অন্য দুইটি ছিল আধুনিক উপায়ে সমীকরনের মুল নির্ণয় সম্পর্কিত এবং নাম্বার থিওরি নিয়ে। শেষোক্তটি বেশ গুরুত্ববাহি, কারণ finite field এর ধারণা প্রথম এখানেই পাওয়া যায়। সে বছর গ্যালোয়া তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিরেক্টরকে গালিগালাজ করে একটি প্রতিবেদন লেখেন। ডিরেক্টর ছিলেন প্রজাতন্ত্রের সমর্থক। সুতরাং তাকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের করে দেয়া হয় । এরপর তিনি যেন পুরোই উচ্ছনে গেলেন।

বছর ঘুরতেই (১৮৩১) মদ আর সন্ত্রাস তার নিত্যসঙ্গী হয়ে যায়। কখনও চাকু হাতে সম্রাটকে হত্যার হুমকি দিচ্ছেন খোলা রাস্তায়, তো পরক্ষনে গ্রেফতার। ছাড়া পেয়ে আবার নিষিদ্ধ ন্যাশনাল গার্ডের পোশাক পরে রাস্তায় বের হলে তাঁর জেল হয়ে যায়। এক মাস পর গ্যালোয়া জেল থেকে ছাড়া পান। কিছুদিন পর তাঁর প্রনয়ের খবর চাঊর হয়ে যায়, প্রেয়সী স্টাফানি ফেলিসি। স্টাফানি এক বিখ্যাত ডাক্তারের মেয়ে, প্যারিসের এক সম্ভ্রান্ত বংশের ছেলে পেশ্চু ডি’হেরবিনভিল এর বাগদত্তা। পেশ্চু এই ঘটনায় খুব রেগে গেলেন। অপমানের জ্বালা সহ্য করতে না পেরে শুটিং ডুয়েলের চ্যালেঞ্জ দেন গ্যালোয়াকে। ডুয়েলের আগের রাতে (১৮৩২) নিজের মৃত্যু সম্পর্কে গ্যালোয়া এতই নিশ্চিত ছিলেন যে সারারাত জেগে তার থিওরেমগুলো লিখে ফেলেন। তাঁর সে রাতের কাজের মধ্যে দিয়ে আলোর মুখ দেখে গ্রুপ থিওরি। সাথে একটি চিঠি লিখেন যে তাঁর যদি পরদিন ডুয়েলে মৃত্যু হয়, তাহলে যেন তাঁর কাজগুলোকে ইউরোপের বড় বড় গণিতবিদদের কাছে পৌছে দেওয়া হয়।

পরদিন, ৩০ মে ১৮৩২ সাল, ডুয়েলে গ্যালোয়াকে নিখুঁত নিশানায় ভুলুন্ঠিত করে পেশ্চু। ৩১ মে মৃত্যু হয় গ্যালোয়ার। কিন্তু মাত্র একরাতে গ্যালোয়া যা লিখছিলেন তার মর্ম উদ্ধার করতে গাউস, জ্যাকোবিদের অনেক গলদঘর্ম হতে হয়েছে। গ্যালোয়ার মৃত্যুর ১৪ বছর পর, ১৮৪৬ সালে লিউভিল সেই কাগজগুলো থেকে যে থিওরি উদ্ধার করেন তা তিনি গ্যালোয়ার থিওরি নামে প্রকাশ করেন। তাঁর কাজের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হচ্ছে গ্যালোয়া থিওরি এবং গ্রুপ থিওরি, যা কিনা বিমূর্ত বীজগণিত এর দুটি প্রধান শাখাঁ।

তথ্যসূত্র

সম্পাদনা
  1. এই ফরাসি ব্যক্তিনামটির বাংলা প্রতিবর্ণীকরণে উইকিপেডিয়া:বাংলা ভাষায় ফরাসি শব্দের প্রতিবর্ণীকরণ-এ ব্যাখ্যাকৃত নীতিমালা অনুসরণ করা হয়েছে।

পাদটীকা

সম্পাদনা