এডওয়ার্ড জেনার
এডওয়ার্ড জেনার (১৭ মে, ১৭৪৯ - ২৬ জানুয়ারি, ১৮২৩) ছিলেন একজন ইংরেজ চিকিৎসক এবং বৈজ্ঞানিক, যিনি গুটিবসন্ত[১] রোগের ভ্যাকসিন আবিষ্কারের পথিকৃৎ, যেটি হলো এই পৃথিবীর প্রথম ভ্যাকসিন। ভ্যাকসিন এবং ভ্যাকসিনেশন শব্দ দুটি এসেছে ভারিওলে ভ্যাকসিনে শব্দ থেকে, যেটি দ্বারা জেনার গরুর পক্সকে নির্দেশ করেছিলেন।
এডওয়ার্ড জেনার | |
---|---|
জন্ম | ১৭ মে, ১৭৪৯ বার্কলে, যুক্তরাজ্য |
মৃত্যু | ২৬ জানুয়ারি ১৮২৩ | (বয়স ৭৩)
জাতীয়তা | ইংরেজ |
পেশা | চিকিৎসক, বৈজ্ঞানিক |
পরিচিতির কারণ | ভ্যাকসিন আবিষ্কার |
উল্লেখযোগ্য কর্ম | অবসারভাসন অন দা মাইগ্রেসন অফ বার্ড |
জেনারকে প্রায়শ রোগ-প্রতিরোধ বিদ্যার জনক [২] বলা হয়, এবং এটিও বলা হয় তিনি অন্য যে কারো থেকে বেশি মানুষের প্রাণ রক্ষা করেছেন। জেনারের সময় ব্রিটিশ জনসংখ্যার ১০% গুটিবসন্তে আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছিল, যে সংখ্যাটা শহরেই ছিল ২০% পর্যন্ত বেশি, সংক্রমণ সহজেই ছড়িয়ে যাচ্ছিল। ১৮২১ সালে জেনার, রাজা চতুর্থ জর্জের প্রধান চিকিৎসক [৩] হিসেবে নিয়োগ পান, সাথে সাথে বার্কলের মেয়র ও ‘জাস্টিস অফ দি পিস’ এর পদেও অভিষিক্ত হন। রয়েল সোসাইটির সদস্য হিসেবে, জীবশাস্ত্রে তিনিই প্রথম কোকিল পাখির ব্রুড পরজীবীতা[৪]> বিশ্লেষণ করেন। ২০০২ সালে বিবিসি জেনারকে ১০০ গ্রেট ব্রিটন্স[৫] এর তালিকায় স্থান দেয়।
জীবন
সম্পাদনাএডওয়ার্ড জেনার ১৭ মে, ১৭৪৯ সালে গ্লৌচেস্টারশায়ারের বার্কলেতে জন্মগ্রহণ করেন । তিনি ছিলেন পিতা-মাতার অষ্টম সন্তান । তার পিতা ছিলেন বার্কলের উপাচার্য, যার কারণে জেনারের প্রাথমিক শিক্ষা ভাল ভাবেই সম্পন্ন হয় । তিনি যখন স্কুলে পড়তেন তখন তাকে স্মল পক্সের জন্য ভারিওলেসন[৬] (আদিম টিকাদান পদ্ধতি) করা হয়, যা তার স্বাস্থ্যে সুদুর প্রসারি প্রভাব ফেলেছিল । ১৪ বছর বয়সে তাকে শিক্ষানবিশ হিসেবে সার্জন ড্যানিয়েল লুডলর কাছে পাঠানো হয় যেখানে তিনি নিজে সার্জন হিসেবে প্রয়োজনীয় সমস্ত শিক্ষা এবং অভিজ্ঞতা লাভ করেন । ১৭৭০ সালে জন হান্টারের অধীনে সেন্ট জর্জ হাসপাতালে তিনি সার্জারি ও অ্যানাটমি বিভাগে যোগদান করেন । হান্টারই তাকে ন্যাচারাল হিস্ট্রির[৭] সাথে পরিচয় করিয়ে দেন এবং রয়াল সোসাইটিতে[৮] তাকে প্রস্তাব করেন । ১৭৭৭ সালের দিকে জেনার বার্কলেতে ফিরে আসেন এবং একজন সফল ডাক্তার এবং সার্জন হিসেবে মানবসেবায় ব্রতী হন ।
প্রাণিবিদ্যা
সম্পাদনা১৭৮৮ সালে এডোয়ার্ড জেনার পূর্বের এক ভুল সংশোধন করে কোকিল পাথির আবাসন প্রক্রিয়া সম্পর্কে তার পর্যবেক্ষণ, পরীক্ষা ও গবেষণা প্রকাশ করেন, যার ফলে তিনি রয়্যাল সোসাইটির ফেলো নির্বাচিত হন ।
কি করে কোকিল পাখির সদ্যোজাত বাচ্চা তার ধারক পাখির ডিম গুলোকে বাসা থেকে নিচে ফেলে দেয় সেটা তিনি বিশ্লেষণ করেন । এই আচরণ দেখে জেনার কোকিল ছানার শারীরবৃত্তীয় অভিযোজন প্রক্রিয়া নিয়ে গবেষণা করেন এবং এই সিদ্ধান্তে পৌঁছান যে, ১২ দিন বয়স হবার পর কোকিল ছানার পিঠে কিছু নতি দেখা দেয়, যা তাকে ধারক পাখির ডিম গুলো ধাক্কা দিতে সাহায্য করে । ১৭৮৮ সালে তার গবেষণা 'ফিলসফিকাল ট্রান্সিক্সন অফ দা রয়্যাল সোসাইটি' গ্রন্থে প্রকাশ করা হয় । কিন্তু জেনারের এই গবেষণার প্রতি সকলের আস্থা ছিল না যত দিন অব্ধি শিল্পী জেমিমা ব্ল্যাকবার্ন , যিনি নিজেও একজন পক্ষী পর্যবেক্ষক, এটি নিজে প্রত্যক্ষ করেন । তার পর্যবেক্ষণ এবং বিবরণ চার্লস ডারউইনকে তার 'অন দা অরিজিন অফ স্পিসিস'[৯]> গ্রন্থটি সংশোধনে বাধ্য করে ।
প্রাণিবিদ্যায় জেনারের আগ্রহ তার টিকাদানের প্রথম পরীক্ষায় বিশেষ ভুমিকা রাখে । তার এই আগ্রহই পরবর্তীতে স্মল পক্স এর ভ্যাকসিন আবিষ্কারে অবদান রাখে।
বিবাহ এবং চিকিৎসা পেশা
সম্পাদনা১৭৮৮ সালের মার্চে জেনার, ক্যাথরিন কিংসকোটকে বিয়ে করেন ।
১৭৯২ সালে তিনি সেন্ট আনড্রুস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.ডি. ডিগ্রি লাভ করেন । এই সময় তিনি আঞ্জিনা পেক্তরিস সম্পর্কে বিশেষ জ্ঞান অর্জন করেন ।
ভ্যাকসিন আবিষ্কার
সম্পাদনাটিকাদান সেই সময়ও করা হতো, কিন্তু তখন অনেক ঝুঁকিপূর্ণ ছিল সে প্রক্রিয়া এবং ভাবা হতো এই প্রক্রিয়ার ফলে আশেপাশের লোকজনও আক্রান্ত হতে পারে, যেহেতু টিকাগ্রহণকারী নিজে রোগের বাহক। ১৭২১ সালে লেডি ম্যারি ওরতলি মন্তাগু কন্সতান্তিপল থেকে টিকাদানের সমস্ত সরঞ্জাম ব্রিটেনে আমদানি করেন । এরপর থেকে জন ফস্তার সহ আরও অনেকে টিকাদান নিয়ে কাজ করলেও জেনার এর পদ্ধতি সকলের প্রচেষ্টাকে ছাড়িয়ে যায় ।
১৪ মে, ১৭৯৬ জেনার তার হাইপোথিসিস সর্বপ্রথম তার মালির আট বছরের ছেলে জেমস ফিলিপ এর ওপর পরীক্ষা করেন । ফিলিপকে জেনার তার টিকাদান সম্পর্কিত প্রকাশনায় ১৭তম কেস হিসেবে উল্লেখ করেছেন ।
ফিলিপের দুই বাহুতে জেনার টিকা দিয়েছিলেন সেদিন, যার ফলে ফিলিপের সামান্য জ্বর দেখা দেয় । কিন্তু সেটা গুরুতর হবার আগেই সে সুস্থ হয়ে উঠে । পরবর্তীতে আর কিছু পরীক্ষা চালালেও ফিলিপ সম্পূর্ণ সুস্থ থাকে, এবং ইনফেকশনের কোন লক্ষণ দেখা দেয় না ।
জেনার তার গবেষণা চালিয়ে যান । শুরুর দিকে রয়্যাল সোসাইটি তার গবেষণাপত্র গুলি গ্রহণ করে নি । কিন্তু আর বিস্তর গবেষণা আর পরীক্ষা নিরীক্ষার পর তার ২৩ টি কেস এর ফলাফল প্রকাশ করা হয়, যার মধ্যে একটি কেস ছিল তার ১১ বছরের ছেলে রবার্টের । তার কিছু সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল, কিছু ছিল ভ্রান্ত; যদিও আধুনিক মাইক্রোবায়োলজি ও অণুবীক্ষণ পদ্ধতি তার গবেষণা গুলো আরও নির্ভুল করে তুলতে পারত । শেষ পর্যন্ত ভ্যাকসিনেশন পদ্ধতি স্বীকৃতি পায়, এবং ১৮৪০ সালে ব্রিটিশ সরকার ভেলরেসন নিষিদ্ধ করে ও বিনামূল্যে ভ্যাকসিনেশন পদ্ধতির সূচনা করে ।
এই সাফল্য সমগ্র ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে এবং আমেরিকা, ফিলিপিন্স, মাকাও ও চীনে ফ্রাঞ্চকো জাভিয়ার ডি বাল্মিসের অধীনে বাল্মিস মিশনে হাজার হাজার লোককে স্মল পক্সের টিকা দেয়া হয় ।
জেনার এর অবিরত গবেষণা তার সাধারণ ডাক্তারি পেশায় বাধা হয়ে দাঁড়ায় । তার সহকর্মী এবং রাজা তাকে এ ব্যাপারে সাহায্য করে, এবং ১৮০২ সালে সংসদ এর পক্ষ থেকে তাকে ১০,০০০ পাউন্ড দেয়া হয়, ভ্যাকসিনেশন পদ্ধতির ওপর আরও গবেষণা করার জন্য । ১৮০৭ সালে রয়্যাল কলেজ অফ ফিজিসিয়ান তার ভ্যাকসিনেশন পদ্ধতির সুদূর প্রসারী অবদানের কথা স্বীকার করলে তাকে আরও ২০,০০০ পাউন্ড প্রদান করা হয় ।
পরবর্তী জীবন
সম্পাদনা১৮০২ সালে জেনার 'অ্যামেরিকান একাডেমী অফ আর্টস অ্যান্ড সায়েন্স' এবং ১৮০৬ সালে 'রয়্যাল সুইডিশ একাডেমী অফ আর্টস অ্যান্ড সায়েন্স' এর ফরেন অনারি মেম্বার হিসেবে নির্বাচিত হন । ১৮০৩ সালে জেনার 'জেনারিয়ান সোসাইটি'র সভাপতি নির্বাচিত হন, যেটির মূল উদ্দেশ্য ছিল স্মল পক্স ভ্যাকসিনকে সবার কাছে পৌঁছে দেয়া । ১৮০৮ সালে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা নিয়ে প্রতিষ্ঠা করা হয় ন্যাশনাল ভ্যাকসিন এস্টাব্লিসমেন্ট । কিন্তু জেনার ও কর্তৃপক্ষের মধ্যে মনোমালিন্য দেখা দিলে তিনি পরিচালক পদ থেকে পদত্যাগ করেন ।
১৮১১ সালে তিনি আবার লন্ডন ফিরে বেশ কিছু স্মল পক্সের রোগীর দেখা পান, যারা আগে ভ্যাকসিন গ্রহণ করেছিল । কিন্তু তিনি লক্ষ করেন রোগের তীব্রতা আগের থেকে অনেক কম ছিল । নাচারাল হিস্ট্রির ওপর তিনি তার গবেষণা চালিয়ে যান । অবশেষে ১৮২৩ সালে, তার জীবনের শেষ বর্ষে, তিনি তার 'অবসারভেসন অন দা মাইগ্রেসন অফ বার্ড' রয়্যাল সোসাইটিতে পেশ করেন।
মৃত্যু
সম্পাদনা২৫ জানুয়ারি, ১৮২৩ সালে এডওয়ার্ড জেনার আপপ্লেক্সি[১০]> (সন্ন্যাসরোগ) দ্বারা আক্রান্ত হন এবং তার শরীরের ডান পাশ পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়ে । তিনি আর এই অবস্থা থেকে উন্নতি করতে পারেন নি এবং ১৮২৩ সালের ২৬ জানুয়ারি তিনি ৭৩ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন ।
ধর্মীয় দর্শন
সম্পাদনাজেনার একজন খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বী ছিলেন যিনি জীবনভোর বাইবেলকে[১১]> তার মূল ভিত্তি হিসেবে গণ্য করেছেন । মৃত্যুর কিছুদিন আগে তিনি বলেছিলেন, 'মানুষ আমার প্রতি কৃতজ্ঞ নয় বলে আমি বিস্মিত হই না, আমি বিস্মিত হই এই ভেবে যে মানুষ সৃষ্টিকর্তার প্রতিও কৃতজ্ঞ নয়, যিনি আমাদের সৃষ্টি করেছেন এবং জীবন দান করেছেন ।
অবদান
সম্পাদনা১৯৭৯ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা[১২]> স্মল পক্সকে বিলুপ্ত রোগ হিসেবে ঘোষণা করে । এটি ব্যাপক জনসচেনতার কারণে হলেও, ভ্যাকসিন ছিল এর অন্যতম কারণ । রোগ প্রতিরোধ বিদ্যার পরবর্তী আরও নানা আবিষ্কারের ভিত্তি জেনার তৈরি করে দিয়ে যান ।
প্রকাশনা
সম্পাদনা১৭৯৮ অ্যান ইঙ্কয়ারি ইনটু দা কজেস অ্যান্ড এফেক্টস অফ দা ভারিওলো ভ্যাকিনি[১৩]>
১৭৯৯ ফারদার অবসারভেসন অন দা ভারিওলো ভ্যাকিনি অর কাউ পক্স[১৪]>
১৮০০ এ কন্টিনিউএসন অফ ফ্যাক্টস অ্যান্ড অবসারভেসন রিলেটিভ টু দা ভারিওলো ভ্যাকিনি[১৫]>
১৮০১ দা ওরিজিন অফ দা ভারিওলো ইনঅকুলেসন[১৬]>
আরও দেখুন
সম্পাদনাতথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ "স্মল পক্স কি" (ইংরেজি ভাষায়)।
- ↑ "vaccines/immunizations-vaccines-power-of-preparation" (ইংরেজি ভাষায়)।
- ↑ "king george-iv" (ইংরেজি ভাষায়)।
- ↑ "brood parasitism" (ইংরেজি ভাষায়)।
- ↑ "100 Greatest Britons (BBC Poll, 2002)" (ইংরেজি ভাষায়)।
- ↑ "smallpox/sp_variolation" (ইংরেজি ভাষায়)।
- ↑ "natural history" (ইংরেজি ভাষায়)।
- ↑ "The Royal Society" (ইংরেজি ভাষায়)।
- ↑ "On-the-Origin-of-Species" (ইংরেজি ভাষায়)।
- ↑ "আপপ্লেক্সি কি" (ইংরেজি ভাষায়)।
- ↑ "christian religious book bibel" (ইংরেজি ভাষায়)।
- ↑ "World Health Organization: WHO" (ইংরেজি ভাষায়)।
- ↑ "An inquiry into the causes and effects of the variolæ vaccinæ, a disease discovered in some of the western counties of England, particularly Gloucestershire, and known by the name of the cow pox" (ইংরেজি ভাষায়)।
- ↑ "Further observations on the variolæ vaccinæ, or cow pox. [electronic resource]" (ইংরেজি ভাষায়)।
- ↑ "favorite share flag textsA continuation of facts and observations relative to the variolae vaccinae, or cow pox" (ইংরেজি ভাষায়)। line feed character in
|শিরোনাম=
at position 15 (সাহায্য) - ↑ "On the origin of the vaccine inoculation" (ইংরেজি ভাষায়)।