উসমানীয় সালতানাতের বিলুপ্তি

উসমানীয় সালতানাতের বিলুপ্তি (তুর্কি: Saltanatın kaldırılması); যার দ্বারা ১৯২২ সালের পহেলা নভেম্বর তুরস্কের গ্র্যান্ড ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি দ্বারা উসমানীয় সাম্রাজ্যের অবসান ঘটে, যা ১২৯৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ১১ নভেম্বর ১৯২২-এ, লোজানের সম্মেলনে, তুরস্কের উপরে অ্যাঙ্গোরা সরকার (বর্তমানে আঙ্কারা) কর্তৃক প্রয়োগ করা গ্র্যান্ড ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির সার্বভৌমত্ব স্বীকৃত হয়। শেষ সুলতান ষষ্ঠ মুহাম্মদ ১৭ নভেম্বর ১৯২২ সালে উসমানীয় রাজধানী কনস্টান্টিনোপল (বর্তমানে ইস্তাম্বুল) ত্যাগ করেন। ২৪শে জুলাই ১৯২৩-এ লোজান চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে আইনি অবস্থান দৃঢ় হয়। মার্চ ১৯২৪ সালের মার্চে খিলাফত বিলুপ্ত হওয়ার মাধ্যমে উসমানীয় প্রভাবের সমাপ্তি চিহ্নিত করে।

ষষ্ঠ মেহমেদ দলমাবাহচে প্রাসাদের পিছনের দরজা দিয়ে প্রস্থান করছেন।

পটভূমি

সম্পাদনা

১১ নভেম্বর ১৯১৪ সালে কেন্দ্রীয় শক্তির সাথে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে উসমানীয়দের প্রবেশ ঘটে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মধ্যপ্রাচ্যের রণাঙ্গন ৩০ অক্টোবর ১৯১৮ তারিখে আর্মিস্টিস অব মুদ্রোস স্বাক্ষরের মাধ্যমে শেষ হয়েছিল। ব্রিটিশ ফরাসি এবং ইতালীয় বাহিনীর দ্বারা কনস্টান্টিনোপল দখল ১৩ নভেম্বর ১৯১৮ সালে ঘটেছিল।

উসমানীয় সাম্রাজ্যের বিভাজন লন্ডন চুক্তির মাধ্যমে শুরু হয়েছিল (১৯১৫)[] এবং একাধিক চুক্তির মাধ্যমে অব্যাহত ছিল, বেশিরভাগই মিত্রশক্তির একতরফা ছিল। ১৯২০ সালের ১৫ মার্চ রাতে সামরিক শাসন প্রতিষ্ঠার পর ব্রিটিশ সৈন্যরা সাম্রাজ্যের মূল ভবনগুলো দখল করতে শুরু করে এবং জাতীয়তাবাদীদের গ্রেপ্তার করে। ১৯২০ সালের ১৮ মার্চ উসমানীয় সংসদে মিলিত হয় এবং মিত্রশক্তির কাছে একটি প্রতিবাদ পাঠায় যে তাদের পাঁচ সদস্যকে গ্রেপ্তার করা অগ্রহণযোগ্য। এটি ছিল সদস্যদের শেষ বৈঠক এবং উসমানীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থার সমাপ্তি চিহ্নিত করে। ১১ এপ্রিল ১৯২০ সালে সুলতান ষষ্ঠ মুহাম্মদ উসমানীয় সাম্রাজ্যের সাধারণ পরিষদ ভেঙে দেন। কনস্টান্টিনোপল সরকার সংসদ ছাড়াই আমলাতন্ত্রের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী হিসাবে সুলতানের সাথে সক্রিয় ছিল।[]

১৯২০ সালের ১০ আগস্ট সেভ্র চুক্তি সাম্রাজ্যের বিভাজন চূড়ান্ত করে। সেই উত্তাল সময়ে আনুমানিক ১৫০ রাজনীতিবিদকে মাল্টায় নির্বাসিত করা হয়েছিল । মোস্তফা কামালের নেতৃত্বে তুরস্কের জাতীয় আন্দোলন ২৩ এপ্রিল ১৯২০ সালে আঙ্কারায় তুরস্কের গ্র্যান্ড ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি প্রতিষ্ঠা করে।

তুরস্কের গ্র্যান্ড ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি তুরস্কের স্বাধীনতা যুদ্ধ পরিচালনা করে। যুদ্ধটি ছিল রাজতান্ত্রিক কনস্টান্টিনোপল সরকারের বিরুদ্ধে।[] সুলতান মুহাম্মদ ষষ্ঠ খলিফা ছিলেন। কনস্টান্টিনোপল সরকার সংসদ ছাড়াই গ্র্যান্ড ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির কুওয়ায়ি মিল্লিয়্যেকে পরাজিত করতে "খিলাফতের সেনাবাহিনী" নামে পরিচিত কুওয়ায়ি ইনজিবাতিয়ে গঠন করে।

তুরস্কের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় অন্যান্য বিদ্রোহের সাথে বোলু, ডুজসে, হেন্দেক, আদাপাজারীতে সংঘাত সংঘটিত হয়েছিল। খিলাফত সেনাবাহিনী খিলাফতের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল, যদিও নামকরণ এবং প্রশিক্ষণ ও অস্ত্রশস্ত্র ব্রিটিশদের দ্বারা প্রস্তুতকৃত ছিল। খিলাফত সেনাবাহিনী এবং ব্রিটিশদের কৌশলগত লক্ষ্য ছিল জাতীয়তাবাদী বাহিনীকে বসপোরাস প্রণালীর দিকে অগ্রসর হওয়া থেকে প্রতিরোধ করা। খিলাফতের সেনাবাহিনী কুওয়ায়ি মিল্লিয়্যের কাছে পরাজিত হয়েছিল। যদিও কুওয়ায়ি মিল্লিয়্যেকে তুরস্কের মুক্তির প্রতিরোধের প্রথম পদক্ষেপ হিসাবে বিবেচনা করা হয়েছিল, অনিয়মিত যুদ্ধ পরে পরিত্যক্ত হয়েছিল। গ্রীক যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে, কুওয়ায়ি মিল্লিয়্যে একটি সংগঠিত তুর্কি সেনাবাহিনীর বীজ হয়ে উঠেছিল। যা পরে একটি প্রজাতন্ত্রের ঘোষণার সাথে তুর্কি সশস্ত্র বাহিনীতে পরিণত হয়।

তুরস্কের গ্র্যান্ড ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির বিরুদ্ধে সুলতানের বাহিনী

উসমানীয় সাম্রাজ্যের সমাপ্তি

সম্পাদনা

উসমানীয় সাম্রাজ্যের সার্বভৌমত্ব প্রথম উসমান রাজবংশের মধ্যে শুরু হয়েছিল, যিনি এর প্রতিষ্ঠাতা এবং নামধারী ছিলেন। তার পরিবার ১২৯৯ সাল থেকে সাম্রাজ্যের ইতিহাস জুড়ে একটি অবিচ্ছিন্ন বংশে শাসন করেছিল। উসমানীয় সুলতানরা উসমানীয় সাম্রাজ্যের রাজনীতির উপর সর্বোচ্চ কর্তৃত্ব বজায় রেখেছিলেন। সুলতান ছিলেন সাম্রাজ্যের একমাত্র এবং নিরঙ্কুশ শাসক, রাষ্ট্রপ্রধান এবং সরকার প্রধান। উসমানীয় সংবিধান দ্বারা প্রতিষ্ঠিত উজিরে আজম এবং রাজতন্ত্র সুলতানের চাহিদা অনুযায়ী কাজ করত।

কনস্টান্টিনোপল এবং আঙ্কারা উভয় সরকারকেই লোজানের সম্মেলনে উপস্থিত হওয়ার জন্য একটি মিত্র আমন্ত্রণ দেওয়া হয়েছিল। মোস্তফা কামাল দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন যে সম্মেলনে শুধুমাত্র আঙ্কারা সরকারের প্রতিনিধিত্ব করা হবে।[] ১৯২২ সালের ১ নভেম্বর, গ্র্যান্ড ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি ঘোষণা করে যে সুলতানের কনস্টান্টিনোপল সরকার আর আইনী প্রতিনিধি নয়। গ্র্যান্ড ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিও সিদ্ধান্ত নেয় যে, মিত্রদের দখলের পর থেকে কনস্টান্টিনোপল জাতীয় রাজধানী থাকছে না।[] এর উপর তারা ঘোষণা করেছিল যে সালতানাত বিলুপ্ত হবে।[] সালতানাতের বিলুপ্তির ফলে উসমানীয় সাম্রাজ্যের অবসান ঘটে। রেজুলেশন শোনার পর, ষষ্ঠ মুহাম্মদ ১৭ নভেম্বর ব্রিটিশ যুদ্ধজাহাজ মালায়ে আশ্রয় প্রার্থনা করেন। [] তার সরকারের বাকি মন্ত্রীরা নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতা মেনে নেন। উসমানীয় সরকার বা সুলতান কর্তৃক রাষ্ট্রকে আত্মসমর্পণ করা হয়েছে বলে কোনো সরকারি দলিল নেই; প্রক্রিয়াটি স্বয়ংক্রিয়ভাবেই সমাধান করা হয়েছিল। ১৯২২ সালের ১১ নভেম্বর লোজানের সম্মেলন উসমানীয় সাম্রাজ্যের পরিবর্তে তুরস্কের গ্র্যান্ড ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির সার্বভৌমত্বকে স্বীকার করে। শেষ সুলতান ষষ্ঠ মুহাম্মদ ১৭ নভেম্বর ১৯২২ সালে কনস্টান্টিনোপল ত্যাগ করেন।

লোজানের সম্মেলনে ৬০০ জনের নামের একটি তালিকা উপস্থাপন করা হয়েছিল, এবং তাদের পার্সোনায়ে নন গ্রাটা হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছিল। উসমানীয় সাম্রাজ্যের নেতাদের এই তালিকার উদ্দেশ্য ছিল উসমানীয়দের শাসক অভিজাতদের নির্মূল করা। লোজানে আলোচনার ফলে সংখ্যাটি একশত পঞ্চাশে সীমাবদ্ধ করা হয়েছিল এবং চুক্তিটি ২৪ জুলাই ১৯২৩ সালে স্বাক্ষরিত হয়েছিল।

উসমানীয় রাজবংশ চতুর্দশ শতাব্দী থেকে উসমানীয় খিলাফতকে ধারণ করে আসছে, যা মুরাদ প্রথমের শাসনামল থেকে শুরু হয়। উসমানীয় পরিবারের প্রধান খলিফা খেতাব রাখেন, যা সমস্ত মুসলমানদের উপর কর্তত্ব প্রমাণ করে। যেমনিভাবে মুহাম্মদের চাচাতো ভাই দ্বিতীয় আব্দুল মজিদ এই উপাধি গ্রহণ করেন। তখন উসমানীয় রাজবংশকে মুহাম্মদের রাজনৈতিক-ধর্মীয় উত্তরসূরি এবং উসমানীয় সাম্রাজ্যের পরে সীমানা ছাড়া সমগ্র মুসলিম সম্প্রদায়ের নেতা হিসাবেই কবেল বাকি রয়েছিল। ১৯১৬ সালে আরব বিদ্রোহের নেতা হেজাজের রাজা হুসাইন বিন আলির দ্বারা আব্দুল মজিদ দ্বিতীয়ের খেতাবকে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছিল, যিনি পঞ্চম মুহাম্মদের নিন্দা করেছিলেন, কিন্তু ১৯২৫ সালে ইবনে সৌদ তার রাজ্য পরাজিত হয়েছিল এবং সংযুক্ত করেছিল।

গ্রীক, বুলগেরীয় এবং সার্ব প্রজারা উসমানীয় সাম্রাজ্যের (১৮২৮-১৯০৮) পতন এবং আধুনিকীকরণের সময় সাম্রাজ্য ত্যাগ করেছিল, যখন আলবেনীয় এবং আর্মেনীয় ( আর্মেনীয় জাতীয় আন্দোলন এবং আর্মেনিয়ার প্রথম প্রজাতন্ত্র) প্রজারা উসমানীয় সাম্রাজ্যের পতনের সময়ে (১৯০৮-১৯২২) ত্যাগ করেছিল বা নিহত হয়েছিল। ১৯২২ সালের মধ্যে তুরস্কের অবশিষ্ট বাসিন্দাদের অধিকাংশই তুর্কি বা কুর্দি জাতিসত্তার মুসলমান ছিল। তুরস্কের গ্র্যান্ড ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি ২৯ অক্টোবর ১৯২৩ তারিখে তুরস্কের প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করে।

উসমানীয় রাজবংশের সদস্যরা ছিলেন যারা প্রজাতন্ত্র ঘোষণার পর তুরস্কে ছিলেন। তুরস্ক প্রজাতন্ত্র[] দ্বারা ২৩ এপ্রিল, ১৯২৪ (পহেলা জুন, ১৯২৪-এ সংশোধিত) একটি নির্বাসিত তালিকাও তৈরি এবং কার্যকর করা হয়েছিল যাতে ক্ষমতাচ্যুত উসমানীয় রাজবংশের ১২০জন বংশধরের নাম অন্তর্ভুক্ত ছিল। []

গ্রন্থপঞ্জি

সম্পাদনা

আরও দেখুন

সম্পাদনা

মন্তব্য

সম্পাদনা
  1. On March 1924 six months after the foundation the vote came to assembly with the abolition of the caliphate[]

তথ্যসূত্র

সম্পাদনা
  1. D. K. Fieldhouse (২০০৮), War and Partition of Ottoman Empire, 1914–1922 – Oxford Scholarship (ইংরেজি ভাষায়), Oxford Scholarship Online, আইএসবিএন 978-0-19-954083-9, ডিওআই:10.1093/acprof:oso/9780199540839.003.0002 
  2. "Mehmed VI | Ottoman sultan"Encyclopædia Britannica (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০১৭-০৫-২২ 
  3. Turkish War of Independence. All About Turkey. Retrieved on 2013-08-12.
  4. Turkish War of Independence. All About Turkey. Retrieved on 2013-08-12.
  5. Turkish War of Independence. All About Turkey. Retrieved on 2013-08-12.
  6. Finkel 2007
  7. Who's Who – Sultan Mehmed VI. First World War.com (2009-08-22). Retrieved on 2013-08-12.
  8. Finkel 2007, পৃ. 546
  9. Finkel 2007