উদ্ভিদজাত ভেষজ
উদ্ভিদজাত ভেষজ (হারবাল) হলো উদ্ভিদবিজ্ঞান এবং ঔষধি উদ্ভিদের একটি ব্যবহার। মানব ইতিহাসে চিকিৎসার জন্য উদ্ভিদই ছিল প্রধান ভরসা, এবং এই ধরনের ঔষধ বর্তমানেও ব্যবহার করা হয়।[১] আধুনিক ঔষধগুলো অনেক বস্তু ব্যবহার করে যেগুলো উদ্ভিদ থেকে নেয়া হয়।[২] উদ্ভিদজাত ভেষজের মাঝে অনেক সময় ছত্রাক এবং মৌমাছি থেকে পাওয়া সামগ্রী, প্রাণীর খোলাস এবং অঙ্গানুকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
উদ্ভিদজাত ভেষজকে ফাইটোমেডিসিন বা ফাইটেথ্যারাপিও বলা হয়।
ইতিহাস
সম্পাদনাপ্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ থেকে জানা যায় প্রায় ৬০,০০০ বছর পূর্বে প্রস্তরযুগ থেকে ঔষধি উদ্ভিদের ব্যবহার হয়ে আসছে। ৫,০০০ বছর পূর্বে সুমরীয় সভ্যতায় উদ্ভিদজাত ভেষজের ব্যবহারের লিখিত প্রমাণ পাওয়া যায় যেখানে বিভিন্ন উদ্ভিদের তালিকা ছিল। হারবালস্ নামক বইয়ে বিভিন্ন উদ্ভিদ ও তাদের ঔষধি ব্যবহারের বর্ণনা পাওয়া যায়। প্রাচীন মিশরে, মিশরীয় চিকিৎসা শাস্ত্রে উদ্ভিদের ব্যবহারের উল্লেখ রয়েছে, যেগুলো মন্দিরের চিত্রে বা চিকিৎসা পাত্রে উদ্ভিদের ব্যবহারের চিহ্ন পাওয়া যায়। প্রাচীন মিশরে ১৫৫০ বিসির সবচেয়ে প্রাচীন, দীর্ঘতম চিকিৎসা শাস্ত্র এবার্স চিকিৎসা শাস্ত্রে ৭০০টি উপাদানের উল্লেখ রয়েছে, যেগুলো প্রধানত গাছের অংশ। হারবাল হিসেবে বীজকে খুব কম ব্যবহার করা হতো যেগুলোর ইতিহাস পাওয়া যায় চীন তামা যুগের প্রত্নতাত্ত্বিক জায়গায়। চীনের প্রথম দিককার একটি চিকিৎসা বই হুয়াংদি নেইজিং এ উল্লেখিত ২২৪টি উপাদানই হলো উদ্ভিদজাত ভেষজ। প্রাচীন ভারতের পরম্পরাগত চিকিৎসাশাস্ত্রেও উদ্ভিদের উল্লেখ রয়েছে।
আধুনিক উদ্ভিদজাত ঔষধ
সম্পাদনাবিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডাব্লিউএইচও) ধারণা করে যে এশিয়া এবং আফ্রিকার দেশগুলোর ৮০ শতাংশ জনসংখ্যা প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার জন্য উদ্ভিদজাত ঔষধ ব্যবহার করে। বিশ্বের বেশিরভাগ জনগোষ্ঠীর জন্য ফার্মাসিউটিক্যাল ঔষধ খুবই দামী, ২০০২ সালে যাদের অর্ধেক $২ ডলারের নিচে প্রতিদিন আয় করতো। পক্ষান্তরে, উদ্ভিদজাত ঔষধকে বীজ থেকে উৎপাদন করা ও পরিবেশ থেকেই বিনামূল্যে বা অল্প খরচে সংগ্রহ করা যায়।
বর্তমানে ঔষধালয়ে যেসকল ফার্মাসিউটিক্যাল ঔষধ পাওয়া যায় সেগুলোর মাঝে বেশিরভাগই একসময় উদ্ভিদজাত ঔষধ হিসেবে ব্যবহার করা হতো, যেগুলোর মাঝে রয়েছে আর্টেমিসিনিন, আফিম, এস্পিরিন, ডিজিটালিস এবং কুইনিন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, প্রায় ২৫% আধুনিক ঔষধ যা যুক্তরাষ্ট্রে পাওয়া যায় সেগুলো উদ্ভিদ থেকে পাওয়া যায়। কমপক্ষে ৭,০০০ ঔষধিন উপাদান উদ্ভিদ থেকে নেয়া হয়।
ব্যবহারের প্রভাব
সম্পাদনাদুরারোগ্য রোগ যেমন ক্যান্সার, বহুমূত্ররোগ, কিডনি রোগের মতো রোগের জন্য হারবাল ঔষধের প্রভাব অনেক বেশি। হারবাল ঔষধের ব্যবহারের প্রভাবশালীতার সাথে লিঙ্গ, বয়স, শিক্ষা, গৌত্র প্রভৃতি বিষয় সম্পর্কযুক্ত।
বিকল্প ঔষধ কারা ব্যবহার করে, কেন ব্যবহার এবং কি ব্যবহার করে এটি নিয়ে ২০০৪সালে "ন্যাশনাল সেন্টার ফর কমপ্লিমেন্টারি এন্ড ইন্টাগ্রেটিভ হেলথ" একটি জরিপ করে। এই জরিপটি যুক্তরাষ্ট্রের প্রাপ্তবয়স্ক, ১৮ বছরের ঊর্ধ্বে যারা তাদের নিয়ে করা হয়। এই জরিপ অনুসারে, ভিটামিন ও মিনারেলের পাশাপাশি হারবাল বা প্রাকৃতিক উপাদন ছিল সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত (১৮.৯%), এখানে সকল প্রকার ইবাদত বা প্রার্থনাকে বাদ দেয়া হয়।
হারবাল ঔষধ ইউরোপে অনেক সাধারণ। জার্মানিতে, ঔষধ বিক্রেতারা হারবাল ঔষধও বিক্রয় করে থাকে। ডাক্তারের দেয়া ঔষধের পাশাপাশি হারবাল চা, তেল বিক্রি করা হয়। উদ্ভিদজাত ঔষধকে বিশুদ্ধ চিকিৎসা উপাদান হিসেবে ভাবা হয় যেটিকে শিল্পকারখানায় উৎপাদন করা হয়।
ভারতে উদ্ভিদজাত ভেষজ এতোটাই জনপ্রিয় যে ভারত সরকার পরিবার ও স্বাস্থ্য কল্যান মন্ত্রনালয়ের অধীনে -আয়ুশ- নামে আলাদা সংস্থা তৈরি করেছে। উদ্ভিদজাত চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণের জন্য ২০০০সালে ভারত সরকার জাতীয় চিকিৎসা উদ্ভিদ বোর্ড গঠন করে।
হারবাল প্রস্তুতি
সম্পাদনাবিভিন্ন মাধ্যমে উদ্ভিদজাত ভেষজ তৈরি করা যেতে পারে, তবে সবচেয়ে সাধারণ মাধ্যম হলো তরল মাধ্যম যেটিকে রোগী গ্রহণ করে থাকে হারবাল চা হিসেবে বা গাছের নির্যাস হিসেবে।
সুরক্ষা
সম্পাদনাকিছু সংক্ষক ঔষধি গাছ বিপরীত প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে।তাছাড়া, "ভেজাল, ভুল সূত্র, উদ্ভিদ সম্পর্কে এবং ঔষধ ব্যবহারের কম ধারণা বিপরীত প্রতিক্রিয়ার তৈরি করতে পারে যেটি অনেক সময় কারও জীবনের জন্য হুমকি স্বরুপ হতে পারে।" চিকিৎসা ক্ষেত্রে ব্যবহারের পূর্বে সকল উদ্ভিদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সঠিক পরীক্ষার প্রয়োজন। যদিও অনেক ব্যবসায়ি মনে করে উদ্ভিদজাত ঔষধ নিরাপদ কারণ এগুলো "প্রাকৃতিক", প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম ঔষধ পরস্পরের উপর ক্রিয়া করে রোগীর বিষাক্ততা তৈরি করতে পারে। হারবাল ঔষধগুলোতেও বিপদজনক আকারে ভেজাল মেশানো হয়ে থাকে।
শিকারীর বিরুদ্ধে উদ্ভিদের রাসায়নিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা রয়েছে যেটি মানুষের উপর বিপরীত প্রতিক্রিয়া করতে পারে। উচ্চমাত্রার বিষাক্ত ভেষজের মাঝের রয়েছে হ্যামলক বিষ এবং নাইটশেড। এই সকল পণ্যগুলো সাধারণ মানুষের কাছে ঔষধ হিসেবে বাজারজাত করা হয়না, কারণ এটির ঝুঁকি সবারই জানা। যদিও বেশি নয়, তবে ব্যাপক ব্যবহারে ভেষজের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে বর্ণনা করা হয়েছে। যকৃত নষ্ট হওয়ার জন্য কালো কহোশকে দায়ী করা হয়। গর্ভবতী নারীদের জন্য উদ্ভিদজাত ঔষধ কতোটা নিরাপদ সেজন্য কিছু গবেষণা রয়েছে।
২০১৮ সালের একটি গবেষণায়, এফডিএ দেখতে পায় "হারবাল", " প্রাকৃতিক" বা "পরম্পরাগত" হিসেবে বিক্রিত ৭০০টির বেশি ঔষধে ফার্মাসিউটিক্যাল উপাদান পাওয়া গিয়েছিল।
নামকরণ সঠিকতা
সম্পাদনা২০১৩সালের একটি জরিপ অনুসারে হারবাল পণ্যের এক-তৃতিয়াংশ নমুনাতে কোন ধরনের উদ্ভিদের নাম ছিলো না। একটি বোতলের নাম ছিল সেইন্ট জন্স ওয়ার্ট যেটাতে আসলে আলেক্সান্দ্রিয়ান সেন্না, রেচক পদার্থ ছিল।
২০১৪সালে এডেলাইড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা জানতে পায় যেসকল পণ্য যাচায় করা হয় সেগুলোর ৬০ শতাংশ পণ্যে কোন উপাদান ছিলনা যে ল্যাবেলের মাঝে উল্লেখ ছিল। ১২১টি পণ্যের মাঝে, মাত্র ১৫টি পণ্য তাদের ল্যাবেলের সাথে মিলেছিল।
সরকারি নিয়ম
সম্পাদনাবিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডাব্লিউএইচও), জাতিসংঘের বিশেষ সংগঠন যেটি জনস্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করে, ১৯৯৮সালে উদ্ভিদজাত ভেষজের জন্য মাননিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি প্রকাশ করে যেটি করা হয় হারবাল উপাদানের মান ও গঠন সঠিক রাখার জন্য।
ইউরোপীয় ইউনিয়নে, উদ্ভিদজাত ঔষধ নিয়ন্ত্রণ করে হারবাল চিকিৎসার পণ্য কমিটি।
কানাডিয় নিয়মকে পরিচালনা করে "ন্যাচারাল এন্ড নন-প্রেসক্রিপশন হেলথ প্রোডাক্টস ডিরেক্টরেট" যেটি লাইসেন্স করা হারবাল ঔষধে একটি আট অঙ্কের প্রাকৃতিক উপাদান সংখ্যা দিয়ে থাকে।
কিছু উদ্ভিদ, যেমন ভাং এবং কোকা বেশিরভাগ দেশে নিষিদ্ধ। যদিও দক্ষিণ আমেরিকার বেশিরভাগ দেশে কোকাকে বৈধ ধরা হয় যেখানে এটিকে উৎপাদন করা হয়। ভাং গাছকে হারবাল চিকিৎসায় ব্যবহার করা হয় এবং এটি বিশ্বের কিছু জায়গায় বৈধ ধরা হয়। ২০০৪সাল থেকে, যুক্তরাষ্ট্রে এফডিএ এফেড্রার বিক্রয় নিষিদ্ধ করেছে।
বৈজ্ঞানিক সমালোচনা
সম্পাদনাহারবাল ঔষধকে এটির পণ্যমান, নিরাপত্তা ঝুঁকি ও স্বাস্থ্যঝুঁকির জন্য সমালোচনা করা হয়। সারা বিশ্বে, বিভিন্ন হারবাল পণ্যের নিরাপত্তা, উপাদান নিয়ে কোন মানদন্ড নেই। আর এসকল পণ্য নিয়ে কোন ভালো মানের বৈজ্ঞানিক গবেষণা নেই।
কিছু হারবাল ঔষধ প্রস্তুতকারকদের অনৈতিক কর্মকাণ্ড, যাদের মধ্যে রয়েছে স্বাস্থ্যের উন্নতি সম্পর্কে ভুয়া বিজ্ঞাপন, পণ্য প্রস্তুতের সময় ভেজাল মেশানো উদ্ভিদজাত ভেষজ সম্পর্কে মানুষের ভরসাকে কমিয়ে দেয়।
পরম্পরাগত ব্যবস্থা
সম্পাদনাআফ্রিকা
সম্পাদনাপ্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা হিসেবে আফ্রিকার জনসংখ্যার ৮০% লোক পরম্পরাগত ঔষধ ব্যবহার করে।
চীন
সম্পাদনাচীনা পরম্পরাগত ও পশ্চিমা চিকিৎসা উভয় সম্পর্কে প্রশিক্ষিত গবেষকরা আধুনিক বিজ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে প্রাচীন চিকিৎসাকে পুনরুদ্ধার করার চেষ্টা করছে।
ভারত
সম্পাদনাভারতে, আয়ুর্বেদিক চিকিৎসার খুবই জটিল প্রস্তুতপ্রণালি রয়েছে যা ৩০ বা তার অধিক উপাদান বিশিষ্ট।
লাদাখ, লাহুল-স্পিটি এবং তিব্বতে তিব্বতিয় চিকিৎসা ব্যবস্থা বিদ্যমান, যেটিকল 'আমিকি চিকিৎসা ব্যবস্থা' বলা হয়। সি.পি. কালা ৩৩৭টির অধিক ঔষধি উদ্ভিদকে তালিকাভুক্ত করেছেন।
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ "Hard to swallow"। Nature। 448 (7150): 105–06। ২০০৭। ডিওআই:10.1038/448106a । পিএমআইডি 17625521। বিবকোড:2007Natur.448S.105.।
- ↑ Lack, Caleb W.; Rousseau, Jacques (২০১৬)। Critical Thinking, Science, and Pseudoscience: Why We Can't Trust Our Brains (ইংরেজি ভাষায়)। Springer Publishing Company। পৃষ্ঠা 212–214। আইএসবিএন 9780826194268।