উইলিয়াম এ এস ওডারল্যান্ড
উইলিয়াম আব্রাহাম সাইমন ওডারল্যান্ড (ওলন্দাজ: Wiliam Ouderland) (৬ ডিসেম্বর ১৯১৭ — ১৮ মে ২০০১) ছিলেন একজন ওলন্দাজ-অস্ট্রেলীয় সামরিক কমান্ডো অফিসার। তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষ অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে বাংলাদেশের চতুর্থ সর্বোচ্চ সামরিক খেতাব বীর প্রতীক প্রদান করে। তিনিই একমাত্র বিদেশী যিনি এই রাষ্ট্রীয় খেতাবে ভূষিত হয়েছেন।[১][২][৩] বাংলাদেশের প্রতি অপরিমেয় ভালবাসার জন্য বাঙ্গালী জাতির কাছে তিনি বিশেষভাবে সম্মানিত ও স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব।[৪] তার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধার নিদর্শনস্বরূপ বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার গুলশানের একটি রাস্তার নামকরণ করা হয়েছে।
উইলিয়াম আব্রাহাম সাইমন ওডারল্যান্ড | |
---|---|
জন্ম | |
মৃত্যু | ১৮ মে ২০০১ পশ্চিম অস্ট্রেলিয়া, অস্ট্রেলিয়া | (বয়স ৮৩)
জাতীয়তা | অস্ট্রেলীয় |
শিক্ষা | প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভ করেননি |
পেশা | চাকুরিজীবী |
নিয়োগকারী | বাটা জুতা প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান |
উল্লেখযোগ্য কর্ম | দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ |
আদি নিবাস | আমস্টারডাম, হল্যান্ড |
দাম্পত্য সঙ্গী | মারিয়া |
সন্তান | ১ মেয়ে |
পুরস্কার | বীরপ্রতীক |
প্রারম্ভিক জীবন
সম্পাদনাওডারল্যান্ড ১৯১৭ সালের ৬ ডিসেম্বর নেদারল্যান্ডসের রাজধানী আমস্টারডাম শহরে জন্মগ্রহণ করেন। অস্ট্রেলিয়া ওডারল্যান্ডের পিতৃভূমি ছিল।[৫] তিনি কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভ করেননি। ১৭ বছর বয়সে তাকে লেখাপড়া ছেড়ে জীবিকার জন্য জুতা-পালিশের কাজ নিতে হয়[২] এবং পরে তিনি বাটা শু কোম্পানি নামক জুতানির্মাতা প্রতিষ্ঠানে যোগ দেন। দুই বছর পর চাকরি ছেড়ে ১৯৩৬ সালে জার্মানি কর্তৃক নেদারল্যান্ডস দখলের আগে ঔডারল্যান্ড ওলন্দাজ জাতীয় সামরিক বাহিনী নাম লেখান। পরবর্তীতে তিনি রাজকীয় সংকেত বিভাগে (রয়্যাল সিগনাল কোর) সার্জেন্ট পদে নিযুক্ত হন এবং তার দলে ৩৬ জন সদস্য ছিল। (( তিনি ১৯৪৪ সাল পর্যন্ত উক্ত পদে কর্মরত ছিলেন। এরপর তিনি ওলন্দাজ বাহিনীর গেরিলা কম্যান্ডো হিসেবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে (১৯৩৯-১৯৪৫) অংশগ্রহণ করেন।)) জার্মানি কর্তৃক নেদারল্যান্ড, ফ্রান্স ও বেলজিয়াম দখল করার ফলশ্রুতিতে ঔডারল্যান্ডকে গ্রেফতার করা হয়। তবে তিনি বন্দীদশা থেকে পালিয়ে যেতে সমর্থ হন এবং জার্মানি থেকে ফেরত সৈন্যদের প্রশিক্ষণ দেবার কাজে নিযু্ক্ত হন। ((ঔডারল্যান্ড জার্মান ভাষা ও ওলন্দাজ ভাষায় পারদর্শী ছিলেন)) এবং এর মাধ্যমে তিনি ওলন্দাজ গোপন প্রতিরোধ আন্দোলনের হয়ে গুপ্তচর হিসেবে কাজ করেন।[১]
মুক্তিযুদ্ধে অবদান
সম্পাদনাওডারল্যান্ড ঢাকায় বাটা স্যু কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে নেদারল্যান্ডস থেকে ১৯৭০ সালের শেষ দিকে প্রথম ঢাকায় আসেন।[২] কয়েক মাসের মধ্যেই তিনি নির্বাহী পরিচালক পদে পদোন্নতি লাভ করেন। টঙ্গীর বাটা জুতো কারখানায় কর্মরত অবস্থায় ১৯৭১ সালের ৫ মার্চ মেঘনা টেক্সটাইল মিলের সামনে শ্রমিক-জনতার মিছিলে ইপিআর-এর সদস্যদের গুলিবর্ষণের ঘটনা কাছে থেকে দেখেছেন। পূর্ব পাকিস্তানের ১৯৭১-এ মার্চের গণ আন্দোলন, ২৫ মার্চ এর অপারেশন সার্চলাইট এবং এর পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর নির্বিচার হত্যাকাণ্ড ও নৃশংস বর্বরতা দেখে মর্মাহত হন এবং যুদ্ধে বাংলাদেশকে সাহায্য করার সিদ্ধান্ত নেন।[১]
বাটা স্যু কোম্পানীর মত বহুজাতিক একটি প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হওয়াতে তার পশ্চিম পাকিস্তানে অবাধ যাতায়াতের সুযোগ ছিল। এই সুবিধার কারণে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর নীতিনির্ধারক মহলে অনুপ্রবেশ করার এবং বাংলাদেশের পক্ষে গুপ্তচরবৃত্তি করার। তিনি প্রথমে ঢাকা সেনানিবাসের ২২ বেলুচ রেজিমেন্টের অধিনায়ক লেফট্যানেন্ট কর্ণেল সুলতান নেওয়াজের সঙ্গে অন্তরঙ্গ সখ্য গড়ে তোলেন। সেই সুবাদে শুরু হয় তার ঢাকা সেনানিবাসে অবাধ যাতায়াত। এতে তিনি পরিচিত ও ঘনিষ্ঠ হতে থাকলেন আরো বেশি সংখ্যক সিনিয়র সেনা অফিসারদের সাথে। এর এক পর্যায়ে লেফট্যানেন্ট জেনারেল টিক্কা খান, পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার লেফট্যানেন্ট জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজী, এডভাইজার সিভিল এফেয়ার্স মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলি সহ আরো অনেক সামরিক বেসামরিক কর্মকর্তাদের সাথে তার হৃদ্যতা গড়ে ওঠে। নিয়াজীর ইস্টার্ন কমান্ড হেডকোয়ার্টার তাকে 'সম্মানিত অতিথি' হিসাবে সম্মানিত করে। এই সুযোগে তিনি সব ধরনের 'নিরাপত্তা ছাড়পত্র' সংগ্রহ করেন। এতে করে সেনানিবাসে যখন তখন যত্রতত্র যাতায়াতে তার আর কোন অসুবিধা থাকল না। তিনি প্রায়শঃ সেনানিবাসে সামরিক অফিসারদের আলোচনা সভায় অংশগ্রহণের সুযোগ পান। এক পর্যায়ে তিনি পাকিস্তানিদের গোপন সংবাদ সংগ্রহ করা শুরু করলেন। এসকল সংগৃহীত সংবাদ তিনি গোপনে প্রেরণ করতেন ২নং সেক্টর এর ক্যাপ্টেন এ. টি. এম. হায়দার এবং জেড ফোর্সের কমান্ডার মেজর (পরবর্তীতে লেফটেনেন্ট জেনারেল) জিয়াউর রহমান এর কাছে।[১]
তিনি গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের খাদ্যদ্রব্য সরবরাহ, আর্থিক সহায়তা এবং বিভিন্ন উপায়ে সাহায্য করতেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে গেরিলা কমান্ডো হিসেবে স্বীয় অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করে স্বয়ং ২নং সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধা গেরিলা শাখার সক্রিয় সদস্যরূপে অকুতোভয় ঔডারল্যান্ড বাটা কারখানা প্রাঙ্গণসহ টঙ্গীর কয়েকটি গোপন ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়মিত গেরিলা রণকৌশলের প্রশিক্ষণ দিতেন। কমান্ডো হিসাবে তিনি ছিলেন অস্ত্র, গোলাবারুদ এবং বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ। এক পর্যায়ে তিনি নিজেই জীবন বিপন্ন করে যুদ্ধে নেমে পড়েন। তিনি বাঙালি যোদ্ধাদের নিয়ে টঙ্গী-ভৈরব রেললাইনের ব্রিজ, কালভার্ট ধ্বংস করে যোগাযোগ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত করতে থাকেন। তার পরিকল্পনায় ও পরিচালনায় ঢাকা ও এর পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলোতে বহু অপারেশন সংঘটিত হয়। মেজর হায়দারের দেয়া এক সনদপত্রের সূত্রে জানা যায় যে, ওডারল্যান্ড মুক্তিযুদ্ধে গণযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ, পরামর্শ, নগদ অর্থ, চিকিৎসা সামগ্রী, গরম কাপড় এবং অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করেছেন।[১]
এর পাশাপাশি তিনি মুক্তিযুদ্ধের গোড়ার দিকে বাংলাদেশে পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংস নির্যাতন ও গণহত্যার আলোকচিত্র তুলে গোপনে বহিঃবিশ্বের বিভিন্ন তথ্যমাধ্যমে পাঠাতে শুরু করেন এবং মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে বিশ্ব জনমত গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বিরাট অবদান রাখেন।[১] এ বিষয়ে তিনি নিজেই লিখেছেন, ইউরোপের যৌবনের অভিজ্ঞতাগুলো আমি ফিরে পেয়েছিলাম। মনে হচ্ছিল, বাংলাদেশে যা কিছু ঘটছে বিশ্ববাসীকে সেসব জানানো উচিত। ইউরোপে ফেলে আসা যুদ্ধস্মৃতির ২৯ বছর পর ১৯৭১ সালে টঙ্গীতে বর্বর পাকিস্তানি সেনাদের মধ্যে আবার তিনি সাক্ষাৎ পেলেন নাৎসি বাহিনীর। টঙ্গীতে বর্বর পাকিস্তানি বাহিনী দ্বারা নৃশংস হত্যাকাণ্ড, বীভৎস মরণযজ্ঞ প্রত্যক্ষ করে তিনি ব্যথিত হন। তাই ঔডারল্যান্ড ছবি তোলা রেখে সরাসরি যুদ্ধে অংশ্রগহণের সিদ্ধান্ত নেন।(( যুদ্ধকালে তিনি প্রধান সেনাপতি এম এ জি ওসমানীর সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। সে সময় তিনি ঢাকাস্থ অস্ট্রেলিয়ান ডেপুটি হাইকমিশনের গোপন সহযোগিতা পেতেন। ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধ শেষ হবার পর তিনি ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করেন এবং পূর্বতন কর্মস্থলে যোগদান করেন। তিনি ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে অবস্থান করে নিজ দেশ অস্ট্রেলিয়ায় চলে যান।))
স্বীকৃতি
সম্পাদনামহান মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অংশগ্রহণ ও অসামান্য নৈপুণ্যতার কারণে পরবর্তীকালে বাংলাদেশ সরকার তাকে বীরপ্রতীক সম্মাননায় ভূষিত করেন। স্বাধীনতা যুদ্ধে বীর প্রতীক পুরস্কারপ্রাপ্তদের তালিকায় তার নাম ২ নম্বর সেক্টরের গণবাহিনীর তালিকায় ৩১৭ নম্বর। ১৯৯৮ সালের ৭ মার্চ প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনা ও সনদপত্র বিতরণ অনুষ্ঠানে ঔডারল্যান্ডকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। কিন্তু তিনি অসুস্থ থাকায় আসতে পারেননি। তিনি বীর প্রতীক পদকের সম্মানী ১০,০০০ টাকা মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টে দান করে দেন।[১] একমাত্র বিদেশি হিসেবে তাকে বাংলাদেশ সরকার এই খেতাবে ভূষিত করেছে। মৃত্যুর পূর্বমূহুর্ত পর্যন্ত অত্যন্ত গর্ব ভরে ও শ্রদ্ধার্ঘ্য চিত্তে নামের সঙ্গে বীর প্রতীক খেতাবটি লিখেছিলেন তিনি।[৫]
জনপ্রিয় মাধ্যমে
সম্পাদনাবাংলাদেশে ২০১৬ সালে ওডারল্যান্ডকে নিয়ে তৈরি হয়েছে তথ্যচিত্র। পরিচালক মাহবুবুর রহমান।[৬]
শেষ জীবন
সম্পাদনাওডারল্যান্ড বাংলাদেশের বাটা স্যু কোম্পানি থেকে ১৯৭৮ সালে অবসর নিয়ে অস্ট্রেলিয়ার ফেরত যান। পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ায় পার্থের এক হাসপাতালে ২০০১ সালের ১৮ মে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।[২]
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ ক খ গ ঘ ঙ চ ছ Bhuiyan, Kamrul Hasan (ফেব্রুয়ারি ১৯৯৯)। জনযুদ্ধের গণযোদ্ধা (Jonojuddher Gonojoddha)। Dhaka: Ramon Publishers। পৃষ্ঠা 60–63। আইএসবিএন 984-8161-75-7
|আইএসবিএন=
এর মান পরীক্ষা করুন: checksum (সাহায্য)। - ↑ ক খ গ ঘ "Ouderland, William AS (Bir Pratik)"। Banglapedia - The National Encyclopedia of Bangladesh। Asiatic Society of Bangladesh। ২০০৭-১২-২১ তারিখে মূল (PHP) থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০০৭-১১-০৪।
- ↑ মুনতাসির মামুন (২০০৯)। কিশোর মুক্তিযুদ্ধকোষ। সময় প্রকাশনী।
- ↑ স্মরণ -ডব্লিউএএস ওডারল্যান্ড বীরপ্রতীক[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
- ↑ ক খ "বিজয়ের ৪০ বছর: বিদেশি সহযোদ্ধা ওডারল্যান্ড: বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধা"। ১০ এপ্রিল ২০১৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৪।
- ↑ "বিদেশি বীর প্রতীককে নিয়ে আজ তথ্যচিত্র, প্রথম আলো, ১০ আগস্ট ২০১৬"। ১৬ জুলাই ২০২০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৬ জুলাই ২০২০।