ইন্দো-আর্য জনগোষ্ঠী

দক্ষিণ এশিয়ার ইন্দো-ইউরোপীয়ভাষী নৃ-ভাষাতাত্ত্বিক গোষ্ঠী
(ইন্দো-আর্য জাতি থেকে পুনর্নির্দেশিত)

ইন্দো-আর্য বা হিন্দার্য জনগোষ্ঠী (ইংরেজি: Indo-Aryan peoples) হচ্ছে একটি বৈচিত্র্যময় ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাভাষী জাতিভাষাভিতিক গোষ্ঠী যারা ইন্দো-আর্য ভাষাসমূহে কথা বলে। ইন্দো-আর্য ভাষায় কথা বলেন এরকম লোক বর্তমানে একশ কোটিরও বেশি। এদের বেশিরভাগই ভারতীয় উপমহাদেশে স্থানীয় এবং বর্তমানে সমগ্র দক্ষিণ এশিয়া জুড়ে এদেরকে পাওয়া যায়, যেখানে এরা প্রাধান্য লাভ করেছে।[note ১]

ইন্দো-আর্য জনগোষ্ঠী
হিন্দার্য জনগোষ্ঠী
এটি ১৯৭৮ সালের মানচিত্র যেখানে প্রধান ইন্দো-আর্য ভাষাসমূহের ভৌগোলিক বণ্টন দেখানো হয়েছে। (উর্দু ভাষাকে হিন্দি ভাষার মধ্যে ফেলা হয়েছে। রোমানি ভাষা, ডোমারি ভাষালোমাভ্রেন ভাষাকে মানচিত্রের আওতার বাইরে রাখা হয়েছে।) ডটযুক্ত বা ফালিযুক্ত অঞ্চলগুলো নির্দেশ করছে যে সেই অঞ্চলগুলোতে বহুভাষিকতার প্রাধান্য দেখা যায়।
মোট জনসংখ্যা
৭টি দেশে প্রায় ১৩০ কোটি
উল্লেখযোগ্য জনসংখ্যার অঞ্চল
 ভারত৯১ কোটি ১০ লক্ষের বেশি[]
 পাকিস্তান২০ কোটি ৪০ লক্ষের বেশি[]
 বাংলাদেশ১৬ কোটির বেশি[]
   নেপাল২ কোটির ৬০ লক্ষের বেশি
 শ্রীলঙ্কা১ কোটি ৪০ লক্ষের বেশি
 মিয়ানমার১০ লক্ষের বেশি
 মালদ্বীপ৩ লক্ষের বেশি
 ভুটান২ লক্ষ ৪০ হাজারের বেশি[]
ভাষা
ইন্দো-আর্য ভাষাসমূহ
ধর্ম
ভারতীয় ধর্মগুলো (বেশিরভাগ লোক হিন্দু, সাথে বৌদ্ধ, শিখ এবং জৈন সংখ্যালঘু রয়েছে) এবং ইসলাম, কিছু নিধার্মিক নাস্তিক্যবাদী/অজ্ঞেয়বাদী এবং খ্রিস্টান

ইতিহাস

সম্পাদনা

বিংশ শতকের কোন কোন তত্ত্ব প্রস্তাব করেছিল যে অতীতের কোন সময়ে ইন্দো-আর্য ভাষাসমূহ বিভিন্ন জায়গায় বিস্তৃত হয়েছে, যা ভাষাবিদ কলিন মাসিকা তার দি ইন্দো-এরিয়ান ল্যাঙ্গুয়েজেস গ্রন্থের "দ্য হিস্টোরিকাল কনটেক্সট এন্ড ডেভেলপমেন্ট অফ ইন্দো-এরিয়ান" অধ্যায়ে লিখেছিলেন।[]

সাম্পতিক কালে ইন্দো-আর্য অভিপ্রায়ণ তত্ত্ব[note ২] দাবী করছে যে ভারতীয় উপমহাদেশে ইন্দো-আর্য ভাষাসমূহ প্রবেশ করে সিনতাশ্তা সংস্কৃতি[][] থেকে মানুষের ব্যাকট্রিয়া-মারজিয়ানা সংস্কৃতি হয়ে ভারতীয় উপমহাদেশে অভিপ্রায়ণের ফলে। অধুনা বিভিন্ন গ্রন্থে, যেমন হার্টউইক কলেজের নৃতত্ত্বের অধ্যাপক ডেভিড এনথনি এর লেখা বাণিজ্যিক পেপারব্যাকদ্য হর্স, দ্য হুইল এন্ড ল্যাঙ্গুয়েজ গ্রন্থে প্রস্তাবিত হয়েছে। এই ভারতীয় উপমহাদেশ এর এই অঞ্চল বর্তমান ভারত, নেপাল, বাংলাদেশপাকিস্তান নিয়ে গঠিত।

প্রায় ১৮০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ইন্দো-আর্য অভিপ্রায়ণ শুরু হয়। ততদিনে যুদ্ধরথের আবিষ্কার হয়ে গিয়েছিল। এই অভিপ্রায়ণের পর লেভান্ত এবং সম্ভবত অন্তঃস্থিত এশিয়ায় ইন্দো-আর্য ভাষার বিস্তার ঘটে। এটি প্রোটো-ইন্দো-ইউরোপীয় বাসভূমি থেকে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাসমূহের ছড়িয়ে যাবার একটি অংশ ছিল। প্রোটো-ইন্দো-ইউরোপীয় বাসভূমি পন্টিক-কাস্পিয়ান স্তেপে অবস্থিত, যা পূর্ব ইউরোপের তৃণভূমির একটি বিশাল অঞ্চল। প্রোটো-ইন্দো-ইউরোপীয়দের নিজ বাসভূমি থেকে অভিপ্রায়ণ শুরু হয়েছিল খ্রিস্টপূর্ব ৫ম থেকে ৪র্থ সহস্রাব্দে। এবং ইউরেশীয় স্তেপ থেকে ইন্দো-ইউরোপীয় অভিপ্রায়ণ শুরু হয় প্রায় ২০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে।[][]

এই তত্ত্ব অনুসারে, এই ইন্দো-আর্য ভাষাভাষী জনগোষ্ঠী একটি জিনগত বৈচিত্র্যপূর্ণ গোষ্ঠী যারা একই সাংস্কৃতিক নিয়মাবলি ও ভাষার দ্বারা একতাবদ্ধ, এবং এরা "আর্য" (অভিজাত) হিসেবে পরিচিত। এই সংস্কৃতি ও ভাষার বিস্তৃতি ঘটেছিল পৃষ্ঠপোষক-অনুগ্রহপ্রার্থী ব্যবস্থায় (প্যাট্রন ক্লায়েন্ট সিস্টেমে), যার ফলে অন্যান্য গোষ্ঠীর এই সংস্কৃতিতে অভিনিবেশ ও সংস্কৃতায়ন ঘটে। এটা ইন্দো-আর্য জনগোষ্ঠীতে অন্যান্য সংস্কৃতির শক্তিশালী প্রভাবকে ব্যাখ্যা করে, যেখানে সেই সংস্কৃতিগুলোর সাথে ইন্দো-আর্য সংস্কৃতির মিথোস্ক্রিয়া ঘটেছিল। ইন্দো-আর্য এবং ইরানীয়দের জন্ম হয়েছিল প্রত্ন-ইন্দো-ইরানীয় সংস্কৃতি থেকে। ২১০০ থেকে ১৮০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে কাস্পিয়ান সাগরের উত্তরে মধ্য এশীয় স্তেপে সিনতাশতা সংস্কৃতি হিসেবে প্রোটো-ইন্দো-ইরানীয় সংস্কৃতির বিকাশ ঘটে।[১০][১১][১২][১৩] পরবর্তীতে ১৮০০ থেকে ১৪০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে আরাল সাগরের চারপাশে তা এন্দ্রোনোভো সংস্কৃতি হিসেবে আরও বিকশিত হয়।[১৪] সেই অঞ্চলে বর্তমান কাজাখস্তান, উজবেকিস্তান এবং তুর্কমেকিস্তান অবস্থিত। এই প্রোটো-ইন্দো-ইরানীয়রা দক্ষিণ দিকে অভিপ্রায়ণ করে ব্যাকট্রিয়া-মারজিয়ানা সংস্কৃতি তৈরি করে যেখান থেকে তারা তাদের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ধর্মীয় বিশ্বাস এবং ধর্মীয় আচার নিয়ে আসে। ১৮০০ থেকে ১৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ইন্দো-আর্যরা ইরানীয়দের থেকে আলাদা হয়ে যায়।[১৫] এরপর ইন্দো-আর্যরা লেভান্ত ও উত্তর-পশ্চিম ভারতে অভিপ্রায়ণ করে।[১৬] অন্যদিকে ইরানীয়রা ইরানে অভিপ্রায়ণ করে। এই উভয় গোষ্ঠীই তাদের নিজেদের সাথে ইন্দো-ইরানীয় ভাষা নিয়ে আসে।

অনেকে এই তত্ত্বের বিরুদ্ধে গিয়ে বলেন যে ইন্দো-আর্য সংস্কৃতি সিন্ধু সংস্কৃতি থেকে এসেছে। এই প্রস্তাবের উপর ভিত্তি করে ইন্দো-আর্য সংস্কৃতি এর ধারণার ভিত্তি গঠিত হয়, যে ধারণাটি পরবর্তিতে বিকশিত হয়।[১৭] দেশীয় আর্য তত্ত্ব নামে আরেকটি বিকল্প দাবি রয়েছে যা অনুসারে ইন্দো-আর্য ভাষাগুলোর উৎপত্তি সম্পূর্ণভাবে ভারতীয় উপমহাদেশেই, এবং তারপর এই ভাষাগুলো ভারতীয় উপমহাদেশের বাইরে বিস্তৃত হয়েছে। এই তত্ত্বটি মূলধারার পণ্ডিতগণ প্রত্যাখ্যান করেছেন।[১৮][১৯][২০][২১]

ইন্দো-আর্য জনগোষ্ঠীর তালিকা

সম্পাদনা

ঐতিহাসিক

সম্পাদনা
 
ইন্দো-ইরানীয় অভিপ্রায়ণের পর পুরাতাত্ত্বিক সংস্কৃতিসমূহ (EIEC এর পর)। এন্দ্রোনোভো সংস্কৃতি, ব্যাকট্রিয়া মারজিয়ানা পুরাতাত্ত্বিক সংস্কৃতি, এবং ইয়াজ সংস্কৃতিকে প্রায়ই ইন্দো-ইরানীয় অভিপ্রায়ণের সাথে সম্পর্কিত করা হয়েছে। জিজিসি সংস্কৃতি, সেমেটারি এইচ সংস্ক্রিতি, কপার হোর্ড সংস্কৃতি এবং পিজিডব্লিউ সংস্কৃতি ইন্দো-আর্য অভিপ্রায়ণ এর সাথে সম্পর্কিত হবার প্রার্থী।

সমসাময়িক

সম্পাদনা

আরও দেখুন

সম্পাদনা
  1. রাইখ এট. আল (২০০৯) বলেন, জিনগতভাবে ইন্দো-আর্য ভাষাভিত্তিক গোষ্ঠী প্রধাণত ভারতের উত্তরাঞ্চলে আছে। ভারতীয় উপমহাদেশের সকল দক্ষিণ ভারতীয় জিনগতভাবে দুটো ভিন্ন প্রাচীন জনসংখ্যার মিশ্রণ যাদেরকে পূর্বপুরুষগত উত্তর ভারতীয় (ANI বা এনসেস্ট্রাল নর্থ ইন্ডিয়ান) ও পূর্বপুরুষগত দক্ষিণ ভারতীয় (ASI বা এনসেস্ট্রাল সাউদ ইন্ডিয়ান) বলা হয়। পূর্বপুরুষগত উত্তর ভারতীয় দলটি মধ্য প্রাচ্য, মধ্য এশিয়া এবং ইউরোপীয়দের সাথে জিনগতভাবে নিকটস্থ। অন্যদিকে পূর্বপুরুষগত দক্ষিণ ভারতীয় দলটি ভারতীয় উপমহাদেশের বাইরের কোন বড় আধুনিক গোষ্ঠীর সাথে জিনগতভাবে নিকটস্থ নয়। এই মিশ্রণ ভারতীয় উপমহাদেশের সকল অঞ্চলে ও সকল মানুষের মধ্যে সমানভাবে হয়নি, বরং বিভিন্ন স্থানে উপগাঠনিকভাবে হয়েছে। বিভিন্ন ভৌগোলিক স্থানে, একাধিকবার এবং কয়েক হাজার বছর ধরে এই মিশ্রণ ঘটেছে, আর এর ফলে গথিত হয়েছে বর্তমান দক্ষিণ ভারতীয় জনসংখ্যা। দ্রাবিড়ীয় ভাষাভাষী এবং ঐতিহ্যগত মধ্য ও নিম্নবর্ণের লোকেদের তুলনায় ইন্দো-আর্য ভাষাভাষী এবং ঐতিহ্যগত উচ্চ বর্ণের লোকেদের মধ্যে ANI পূর্বপুরুষত্ব অধিক রয়েছে।
  2. এখন কেবল ইন্দো-আর্য অভিপ্রায়ণ তত্ত্বের বিরোধীরাই "আক্রমণ" বা "Invasion" শব্দটি ব্যবহার করেন।[] "আক্রমণ" শব্দটি ইন্দো-আর্য অভিপ্রায়ণের সমসাময়িক শিক্ষায়তনিক সাহিত্যে গৃহীত হয়না।[]

তথ্যসূত্র

সম্পাদনা
  1. "India"The World Factbook। ১১ জুন ২০০৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১২ ডিসেম্বর ২০১৮ 
  2. "Pakistan"The World Factbook। ২২ মে ২০২০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১২ ডিসেম্বর ২০১৮ 
  3. "Bangladesh"The World Factbook। ২৫ এপ্রিল ২০২০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১২ ডিসেম্বর ২০১৮ 
  4. "Population of Lhotshampas in Bhutan"UNHCR। ২০০৪। ২০১২-১০-১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৬-০৩-২৩ 
  5. Masica, Colin P. (৯ সেপ্টেম্বর ১৯৯৩)। "The Historical Context and Development of Indo-Aryan"। The Indo-Aryan Languages। Cambridge University Press। পৃষ্ঠা 32–60। আইএসবিএন 978-0-521-29944-2 
  6. Witzel 2005, পৃ. 348।
  7. Anthony 2007, পৃ. 408–411.
  8. Kuz'mina 2007, পৃ. 222.
  9. Beckwith 2009, পৃ. 33।
  10. Anthony 2007, পৃ. 408–411।
  11. Anthony 2009, পৃ. 390 (fig. 15.9), 405–411।
  12. Kuz'mina 2007, পৃ. 222।
  13. Anthony 2007, পৃ. 390 (fig. 15.9), 405-411।
  14. Anthony 2009, পৃ. 49।
  15. Anthony 2007, পৃ. 408।
  16. George Erdosy(1995) "The Indo-Aryans of Ancient South Asia: Language, Material Culture and Ethnicity.", p.279
  17. Olson, Carl (২০১৬)। Religious Ways of Experiencing Life: A Global and Narrative Approach। Routledge। পৃষ্ঠা 136। 
  18. Witzel 2001, পৃ. 95।
  19. Jamison 2006
  20. Guha 2007, পৃ. 341।
  21. Fosse 2005, পৃ. 438।

বহিস্থ সূত্র

সম্পাদনা