আবু সুফিয়ান ইবনুল হারিস
আবু সুফিয়ান ইবনুল হারিস (মৃত্যু- ১৫ হিজরি) ইসলাম প্রতিষ্ঠা হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত ইসলামের চরম শত্রু থাকলেও মক্কা বিজয়ের প্রাক্কালে ইসলাম গ্রহণ করেন। এবং তিনি নবী মুহাম্মদ এর একজন চাচাত ভাই ও সাহাবা ছিলেন, এমনকি দুধ ভাইও ছিলেন। তার চেহারার সাথে রাসুলের চেহারার বেশ মিল ছিল। তিনি মাঝে মধ্যে কবিতা রচনা করতেন।[১]
নাম ও বংশ পরিচয়
সম্পাদনাইবনুল মুবারকের মতে আবু সুফিয়ান ইবনুল হারিসের ছিল নাম মুগীরা এবং ডাকনাম ছিল আবু সুফিয়ান । এ নামেই তিনি পরিচিতি লাভ করেন।[২][৩] আবু সুফিয়ানের পিতা নাম হারিস, যিনি রাসূল এর বড় চাচা ছিলেন।[৪]
রাসূল ও আবু সুফিয়ান পরষ্পর দুধ ভাই ছিলেন, তারা হালীমা আস-সাদিয়্যাহর দুধ পান করেন। রাসূল নবুওয়াত প্রাপ্তির পূর্ব পর্যন্ত তাদের দু’জনের মধ্যে গভীর সম্পর্ক ছিল। দু’জনের চেহারার মধ্যেও যথেষ্ট মিল ছিল।
ইসলামের বিরোধিতা
সম্পাদনাতিনি রাসুল পারিবারিক লোক হলেও ইসলাম প্রকাশ হওয়ার পরই তিনি ইসলামের ঘোর বিরোধিতা শুরু করেন। রাসূল যখন দাওয়াত দিতে শুরু করেন আবু সুফিয়ান তখন কুরাইশদের একজন নামযাদা অশ্বারোহী বীর এবং শ্রেষ্ঠ কবি। তিনি ইসলামের বিরোধীতা করা শুরু করেন। ইসলাম ও মুসলমানদের শত্রুতায় তিনি তার সকল শক্তি একীভূত করেন। রাসূলের বিরুদ্ধে কুরাইশরা যত যুদ্ধের পরিকল্পনা করে তার সবগুলোতে আবু সুফিয়ান ইন্ধন যোগায়।
কুরাইশদের হাতে মুসলমানরা যত রকমের কষ্টভোগ করে তাতে তার বিরাট অবদান ছিল। তিনি তার কাব্য রচনার শক্তি রাসূল নিন্দার কাজে ব্যবহার করেন। রাসূলের বিরুদ্ধে তিনি একটি অশালীন কবিতাও রচনা করেন।[২] ইসলামের সাথে আবু সুফিয়ানের এ শত্রুতা দীর্ঘ ২০ বছর চলে। এ দীর্ঘ সময়ে আল্লাহর রাসূল ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে যতরকম ষড়যন্ত্র করা যেতে পারে সবই তিনি করেন।
ইসলাম গ্রহণ
সম্পাদনাঅবশেষে মক্কা বিজয়ের প্রাক্কালে ইসলামের প্রতি আবু সুফিয়ানের শত্রুতার সমাপ্তি ঘটে । যখন চারিদিকে শোনা গেল মুহাম্মদ তার সৈন্যবাহিনী নিয়ে মক্কায় প্রবেশ করবেন তখন তিনি অত্যন্ত চিন্তিত হয়ে পড়লেন। কেননা তিনি ইসলামের যত বিরোধিতা করেছেন তাতে মুসলিম বাহিনী তাকে হত্যা করে ফেলতে পারে, এই ভয় তার মনে ঢুকে গিয়েছিল।
তার স্ত্রী, পুত্র কন্যারাও তাকে বলতে লাগলো আপনার আরো আগেই ইসলাম গ্রহণ করে আপনার চাচাত ভাই মুহাম্মদকে সাহায্য করার দরকার ছিল। ধীরে ধীরে আবু সুফিয়ান ইসলামের প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েন।
আবু সুফিয়ান, রাসুল মক্কায় বিজয়ের জন্য মক্কার উদ্দেশ্যে রওনা হলে আবু সুফিয়ান তার পুত্র জাফরকে সঙ্গে নিয়ে রাসুল এর কাফেলার উদ্দেশ্যে বের হন। তারা খুব দ্রুত মক্কা মদীনার মাঝখানে ‘আবওয়া’র দিকে রওনা দিলো ।তারা আগেই শুনেছিলো মুহাম্মাদ সেখানে পৌঁছেছেন। আবু সুফিয়ান খুব ভয়ে ভয়ে কাফেলা হতে নিরাপদ দূরত্ব থেকে রাসুলকে খুজতে লাগলেন। কেননা রাসুল এর নিকট পৌঁছানোর আগেই তাকে শত্রু ভেবে কেউ হত্যা করতে পারে। তাই তাকে যেন কেও না চিনতে পারে সেজন্য আগেই ছদ্দবেশ ধারণ করেছিলেন। রাসুল কে পাওয়ার পরে দ্রুত তার নিকট পৌঁছালে রাসুল তার দিক হতে মুখ ফিরিয়ে নেন। তারপর আবু সুফিয়ান বিভিন্ন সাহাবা আবু বকর, উমর, তার চাচাত ভাই আলীর নিকট আকুতি-মিনতি করেন ইসলাম গ্রহণ ও রাসুল এর নমনীয়তার জন্য। কিন্তু সবাই তাকে ভর্ৎসনা করতে থাকে। কেউ তার জন্য সুপারিশ করতে রাজি হয়নি। নুয়াইমান ইবনুল হারিস তাকে রীতিমত অপমান ও ভর্ৎসনা করতে থাকে। পরে আবু সুফিয়ানের চাচা আব্বাসের অনুরোধে তিনি থেকে যান।
পরে আবু সুফিয়ানের বিশেষ কাকুতি-মিনতিতে রাসুল তাকে ও আবদুল্লাহ ইবন আবী উমাইয়্যাকে ‘নীকুল উকাব’ নামক স্থানে (মক্কা-মদীনার মাঝামাঝি একটি স্থান) ইসলাম কবুল করান।[১]
ইসলাম গ্রহণের পর
সম্পাদনাইসলাম গ্রহণের পর মক্কায় বিজয়ের পরবর্তী প্রথম যুদ্ধ হুনাইনের যুদ্ধে তিনি অংশগ্রহণ করেন। আবু সুফিয়ান এই যুদ্ধে বিশেষ অবদান রেখে রাসুল কে সন্তুষ্ট করতে চাইলেন।এই যুদ্ধে মুসলমানরা কিছুটা পিছপা হলে আবু সুফিয়ান প্রচণ্ড বেগে যুদ্ধ করতে শুরু করেন। আবু সুফিয়ান ইবনুল হারিস এই হুনাইনের ময়দান থেকে নবীর সন্তুষ্টি অর্জন করতে সমর্থ হন।
অনুতপ্ত জীবন
সম্পাদনাইসলাম গ্রহণের পর আবু সুফিয়ান তার অতীত জীবনের কাজ ও আচরণ এবং ইসলাম থেকে বঞ্চিত হওয়ার কথা চিন্তা করে অনুশোচনায় জর্জরিত হয়েছেন। পরবর্তী জীবনে রাত দিন শুধু কুরআন তিলাওয়াত, কুরআনের বিধি বিধান ও উপদেশাবলী অনুধাবনে অতিবাহিত করতেন। তিনি নিজেকে দুনিয়ার সকল সুখ সম্পদ হতে দূরে রেখে আল্লাহর দিকে মনোযোগী হয়ে পড়েন। তিনি সবার আগে মসজিদে প্রবেশ করতেন এবং সবার শেষে বের হতেন। মুহাম্মাদ ইনতিকালের পর আবু সুফিয়ান খুব কান্না করেছিলেন যা আরবি একটি কবিতায় অতি চমৎকার রূপে ফুটিয়ে উঠেছে ।[১]
হিশাম ইবন উরওয়াহ্ পিতা উরওয়াহ্ থেকে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ বলেনঃ “আবু সুফিয়ান জান্নাতের অধিবাসী যুবকদের নেতা।’’[২]
মৃত্যু
সম্পাদনাহযরত উমারের খিলাফতকালে আবু সুফিয়ান অনুভব করেন, তার জীবন─সন্ধা ঘনিয়ে এসেছে। তিনি একদিন নিজ হাতে একটি কবর খোঁড়েন। এর ৩ দিন পরেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
খলীফা উমার তার জানাযার নামায পড়ান। তার মৃত্যুসন হিজরী ১৫ মতান্তরে হিজরী ২০।