আব্দুর রউফ তালুকদার
আব্দুর রউফ তালুকদার (জন্ম: ১৫ আগস্ট ১৯৬৪) বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর। গভর্নর হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি অর্থ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিল।[২]
আব্দুর রউফ তালুকদার | |
---|---|
১২তম গভর্নর বাংলাদেশ ব্যাংক | |
কাজের মেয়াদ ৪ জুলাই ২০২২ – ৯ আগস্ট ২০২৪[১] | |
পূর্বসূরী | ফজলে কবির |
উত্তরসূরী | নুরুন নাহার (ভারপ্রাপ্ত) |
ব্যক্তিগত বিবরণ | |
জন্ম | কাজীপুর, সিরাজগঞ্জ, পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ) | ১৫ আগস্ট ১৯৬৪
জাতীয়তা | বাংলাদেশ |
প্রাক্তন শিক্ষার্থী |
জন্ম ও ব্যক্তিগত জীবন
সম্পাদনাআব্দুর রউফ তালুকদার ১৯৬৪ সালে সিরাজগঞ্জ জেলার কাজীপুর উপজেলাধীন তারাকান্দি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
তার স্ত্রী সেলিনা রওশন একজন শিক্ষক। তিনি এক কন্যা এবং এক পুত্র সন্তানের জনক।[৩]
শিক্ষা ও কর্মজীবন
সম্পাদনাআব্দুর রউফ তালুকদার যুক্তরাজ্যের বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উন্নয়ন ব্যবস্থাপনায় স্নাতকোত্তর এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউট (আইবিএ) থেকে এমবিএ ডিগ্রী অর্জন করেন।[৪] বিভিন্ন সময়ে শিল্প মন্ত্রণালয়, খাদ্য মন্ত্রণালয় এবং তথ্য মন্ত্রণালয়ে দায়িত্ব পালন করলেও চাকরিজীবনের বেশিরভাগ সময় তিনি কাজ করেছেন অর্থ মন্ত্রণালয়ে। সর্বশেষ এই মন্ত্রণালয় থেকেই তিনি জ্যেষ্ঠ সচিবের দায়িত্ব পালন শেষে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে তার নতুন দায়িত্ব গ্রহণ করেন ১২ জুলাই, ২০২২। অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, তিনি ৪ বছরের জন্য এই দায়িত্ব পালন করবেন।[৫] ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে করা গভর্নরদের সূচকে তিনি ‘ডি গ্রেড' পেয়েছেন। একই র্যাঙ্কিংয়ে ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর শক্তিকান্ত দাস পেয়েছেন ‘এ প্লাস’ গ্রেড এবং শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর নন্দলাল ভীরাসিংহে পেয়েছেন ‘এ মাইনাস'।[৬]
গভর্নর হিসেবে ‘ডি’ গ্রেড প্রাপ্তি
সম্পাদনাবাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্ব নেওয়ার পর মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, স্থানীয় মুদ্রার বিনিময় হারের সুরক্ষা ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সুসংহত করতে ব্যর্থতার ফলস্বরূপ আব্দুর রউফ তালুকদার যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কভিত্তিক গ্লোবাল ফাইন্যান্স ম্যাগাজিনের র্যাংকিংয়ে গভর্নর হিসেবে ‘ডি’ গ্রেড পান।[৭]
এস আলম গ্রুপের সাথে সম্পর্ক
সম্পাদনাগভর্নর আবদুর রউফ তালুকদারের সাথে বাংলাদেশে আর্থিক খাতের দুর্নীতিবাজ প্রতিষ্ঠান এস আলম গ্রুপের সাথে বিশেষ সম্পর্ক ছিলো বলে উল্লেখ করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা। গভর্নরের নিয়োগের পেছনেও এস আলম গ্রুপের বড় প্রভাব ছিল বলে উল্লেখ করা হয়। নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে এস আলম গ্রুপকে সব রকম অবৈধ সুবিধা দেন আবদুর রউফ তালুকদার।[৮] উল্লেখ্য ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান পরবর্তী এস আলম ও তাঁর সহযোগীদের বিরুদ্ধে ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা পাচারের অভিযোগ উঠে।[৯]
দায়িত্ব থেকে পলায়ন ও পদত্যাগ
সম্পাদনা২০২৪ সালে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান পরবর্তী আগষ্টে দায়িত্ব থেকে পালিয়ে যান আবদুর রউফ তালুকদার। দেশের চরম রাজনৈতিক অস্থিরতাতেও কখনোই বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের পালিয়ে যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটেনি, যা ঘটে গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের পালিয়ে যাওয়ার মধ্যদিয়ে।[১০] পরে পালিয়ে থাকা অবস্থায় ৯ আগস্ট ২০২৪ সালে দুপুরে পদত্যাগ করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের ১২তম গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার।[১১]
দুর্নীতি
সম্পাদনাআবদুর রউফ তালুকদার অর্থ সচিব থাকাকালীন করোনার সময়ে লাখো কোটি টাকার বেশি বিশেষ প্রণোদনার চিন্তা করে পুরষ্কার হিসেবে অর্থমন্ত্রী পদ পান। আর প্রণোদনা সুবিধা যারা নিয়েছেন তারা ব্যাংকে কোনো টাকাই ফেরত দিতে পারেননি। এমনকি প্রণোদনার টাকা দিতে গিয়ে তারল্য সঙ্কটে ভুগে ব্যাংকগুলো। যদিও কবে নাগাদ প্রণোদনার এই টাকা ফেরত পাবে এই নিয়েও শঙ্কায় থাকে ব্যাংকগুলো।[১২][১৩]
যদিও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের দায়িত্ব গ্রহণের সময় অনেকেই আব্দুর রউফ তালুকদারের প্রতি আশাবাদী ছিলেন, তবে বাংলাদেশের ইতিহাসে তিনি সবচেয়ে ব্যর্থ ও দুর্নীতিগ্রস্ত গভর্নর হিসেবে বিবেচিত। তার দায়িত্বকালে সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকে অনিয়ম-দুর্নীতি ও লুণ্ঠন সবচেয়ে বেশি বেড়ে যায়। তিনি দায়িত্ব গ্রহণের সময় ২০২২ সালের জুলাইয়ে বাংলাদেশে প্রতি ডলারের বিনিময় হার ছিল ৯৩ টাকা ৪৫ পয়সা। ২০২৪ সালে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান পরবর্তী আগষ্টে দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়ার সময় প্রতি ডলার ১১৮ টাকায় গিয়ে পৌছায়। যদিও খুচরা বাজারে ডলারের দাম ১২৫ টাকারও বেশি দামে বিক্রি হয়।[১৪]
আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে ২০০৯ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে ২৩ হাজার ৪০০ কোটি ডলার বিদেশে পাচার হয়েছে। ২০২৪ সালের বাজারদরে (প্রতি ডলারের দাম ১২০ টাকা) এর পরিমাণ ২৮ লাখ কোটি টাকা। এই হিসাবে প্রতিবছর গড়ে ১ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়। এই মহাদুর্নীতির শেষ সময়কালে বাংলাদেশের আর্থিক খাতের সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের দায়িত্ব পালন করেন আব্দুর রউফ তালুকদার।[১৫]
এছাড়া আবদুর রউফ তালুকদার প্রচলিত নীতিমালা শিথিল করে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোয় লুটপাটের সুযোগ তৈরি করে দিয়েছিলেন। নীতিমালাগুলো এমনভাবে শিথিল করা হয়েছিল যাতে লুটপাটকারীরা বিশেষ সুযোগ পান। লুটপাটের কারণে দুর্বল হওয়া ব্যাংকগুলোয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা ছাপিয়ে বেপরোয়াভাবে ঋণ দেওয়া হয়। ডলার না পেয়েও জোগান দেওয়া হয়েছে ছাপানো টাকার। লাগামহীনভাবে টাকা ছাপিয়ে সরকারকে ঋণ দেওয়ায় বেড়ে যায় মূল্যস্ফীতি। নিজে উদ্যোগী হয়ে একটি ব্যাংককে দখলদারের হাতে তুলে দেওয়ার ঘটনাও ঘটান আবদুর রউফ তালুকদার। এছাড়া সুদের হার এবং ডলারের দাম নির্ধারণে ঘনঘন নীতির বদল করে অর্থনীতিকে অস্থিতিশীল করে তুলেছিলেন। অর্থনীতি ও ব্যাংক খাতে স্থিতিশীলতা রক্ষায় তার দেওয়া কোনো প্রতিশ্রুতিই বাস্তবায়ন হয়নি।[১৬]
আবদুর রউফ তালুকদার নির্ধারিত সীমা লঙ্ঘন করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ২৪ হাজার কোটি টাকা ধার দেন সরকারকে। ওয়েস অ্যান্ড মিনস অ্যাডভান্স (ডব্লিউএমএ) থেকে ১২ হাজার কোটি টাকা এবং ওভার ড্রাফট (ওডি) থেকে নেওয়া হয় ১২ হাজার কোটি টাকা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকে উইন্ডো দুটির প্রতিটি থেকে জরুরি প্রয়োজনে আট হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত ঋণ নেওয়ার সীমা ছিল। জুলাই ও আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান আন্দোলনের সময়ে প্রতিটি উইন্ডো থেকে ১২ হাজার কোটি টাকা করে মোট ২৪ হাজার কোটি টাকা ঋণ দিয়েছেন তিনি। অর্থাৎ ঋণসীমার অতিরিক্ত চার হাজার কোটি টাকা করে বেশি ঋণ দেওয়া হয়। যার অনুমোদন দেওয়া হয়নি।[১৭]
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ "পদত্যাগ করলেন গভর্নর"। সংগ্রহের তারিখ ৯ আগস্ট ২০২৪।
- ↑ "বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার"। Bangla Tribune। ২০২২-০৬-১১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০৬-১১।
- ↑ "বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার"। মানবজমিন। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০৬-১১।
- ↑ "বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার"। সমকাল (ইংরেজি ভাষায়)। ২০২২-০৬-১১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০৬-১১।
- ↑ "বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার"। দৈনিক ইত্তেফাক। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০৬-১১।
- ↑ ডেস্ক, বাণিজ্য (২০২৩-০৯-২৬)। "গভর্নরদের সূচকে ডি গ্রেড পেয়েছেন আব্দুর রউফ তালুকদার"। দৈনিক প্রথম আলো। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০৯-২৬।
- ↑ "গভর্নর হিসেবে আব্দুর রউফ তালুকদারের 'ডি' গ্রেড প্রাপ্তি"। ইনকিলাব। ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩।
- ↑ "গভর্নর ও ডেপুটি নিয়োগ হতো এস আলম গ্রুপের পরামর্শে!"। সময় নিউজ। ২১ আগস্ট ২০২৪।
- ↑ "এস আলম ও তাঁর সহযোগীদের বিরুদ্ধে ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা পাচারের অভিযোগ অনুসন্ধান করছে সিআইডি"। প্রথম আলো। ৩১ আগস্ট ২০২৪।
- ↑ "গভর্নরকে কেন পালাতে হলো, কোথায় আছেন তিনি?"। সময় নিউজ। ২৯ আগস্ট ২০২৪।
- ↑ "কোথায় আছেন হাসিনা সরকারের গভর্নর আবদুর রউফ?"। প্রথম আলো। ৫ আগষ্ট ২০২৪।
- ↑ "রউফের বিচার দাবি"। ইনকিলাব। ১১ আগস্ট ২০২৪।
- ↑ "অর্থ সচিব থাকাকালেও রউফ কুকীর্তির নজির রেখেছেন"। কালবেলা। ২৫ নভেম্বর ২০২৪।
- ↑ "বাংলাদেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে প্রথম পলাতক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার"। বনিক বার্তা। ১১ আগষ্ট ২০২৪।
- ↑ "আওয়ামী লীগ আমলে পাচার ২৮ লাখ কোটি টাকা"। যুগান্তর। ২৯ আগস্ট ২০২৪।
- ↑ "লুটপাটের সহযোগী রউফ"। যুগান্তর। ০২ অক্টোবর ২০২৪। এখানে তারিখের মান পরীক্ষা করুন:
|তারিখ=
(সাহায্য) - ↑ "নিয়ম ভেঙে সরকারকে ঋণ দেন সাবেক গভর্নর"। যুগান্তর। ১৭ অক্টোবর ২০২৪।