আইন প্রণয়ন
আইন প্রণয়ন(অথবা সংবিধিবদ্ধ আইন) হলো এমন আইন, যা কোনো আইন-সভা বা অন্য পরিচালনা সভা অথবা আইন তৈরির নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া দ্বারা ঘোষিত অথবা প্রস্তাবিত।[১] আইনে পরিণত হওয়ার পূর্বে আইন প্রণয়নের কোনো অনুচ্ছেদকে বিল বলা যেতে পারে এবং বৃহত্তর অর্থে আইন প্রণয়ন হিসেবে নির্দেশ করা যেতে পারে, যখন সেটি অন্যান্য বিষয়সমূহ থেকে আলাদা করা হবে কিনা এই বিবেচনায় থাকে। আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে অনেক প্রক্রিয়া থাকতে পারে: তৈরি করা, প্রাধিকার দেওয়া, বাতিল করা, তহবিল প্রদান, অনুমোদন প্রদান, কর্তৃপক্ষের অনুমোদন এবং ঘোষণা করা বা সীমিত করা। এটি কোনো আইনসভার আইন প্রণয়নের জন্য সাংবিধানিক আইনের অধীনে থাকা কার্যনির্বাহী বা প্রশাসনিক সংস্থা কর্তৃক গৃহীত আইনের ভিন্ন হতে পারে।[২]
সংক্ষিপ্ত বিবরণ
সম্পাদনাওয়েস্টমিনস্টার সিস্টেমে প্রাথমিক আইন প্রণয়নের কোনো অংশকে জারি হওয়ার পর সংসদের আইন বলা হয আইন প্রণয়ন সাধারণত আইন-সভার কোনো সদস্যের দ্বারা প্রস্তাবিত হয়, যেখানে সেটির ব্যাপারে আইন-সভার সদস্যারা তর্ক-বিতর্ক করেন এবং প্রায় সময়ই তা অনুমোদন প্রদানের পূর্বে সংশোধন করা হয়। বেশিরভাগ বড় আইনসভা কোনো সভায় প্রস্তাবিত বিলের একটি ছোট অংশ পাস করে।[৩] একটি প্রস্তাবিত বিল পাস হবে কিনা তা সাধারণত শাসন বিভাগের আইনী অগ্রাধিকারের একটি ব্যাপার।
আইন প্রণয়ন শাসন বিভাগের তিনটি প্রধান কাজের একটি। যেগুলো, সাধারণত মতবাদ এবং ক্ষমতা ভেদাভেদের অধীনে প্রভেদ করা হয়। যাদের আইন প্রণয়নের আনুষ্ঠানিক ক্ষমতা আছে তাদের বলা হয় আইন প্রণেতা। শাসন বিভাগের একটি বিচার বিভাগীয় শাখা আইন প্রনয়ণ ব্যাখ্যা করার ক্ষমতা লাভ করে। (দেখুন: সংবিধিবদ্ধ ব্যাখ্যা); শাসন বিভাগের এই কার্যনির্বাহী শাখা শুধু আইনের ঠিক করে দেওয়া ক্ষমতা এবয় সীমার মধ্যে কাজ কনতে পারে, যা শাসন বিভাগের মৌলিক ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করার একটি মাধ্যম।
এর ক্রিয়া এবং কার্যপ্রণালীই প্রধানত আইনসভার দায়িত্ব। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আইন প্রনয়ণ অন্যান্য প্রতিষ্ঠান দ্বারা এবং অন্যান্য উপায়েও আইন প্রনয়ণ তৈরি হয়, যেমন: সাংবিধানিক আইন এবং মাধ্যমিক আইন প্রনয়ণ তৈরির ক্ষেত্রে লক্ষ করা যায়। গণভোট, পরিষদের আদেশ এবং প্রবিধানের মাধ্যমেও আইন তৈরি করা যেতে পারে। 'আইন প্রনয়ণ' শব্দটি কখেনো কখনো এই ব্যাপারগুলো অন্তর্ভুক্ত করে ব্যবহৃত হতে পারে এবং 'প্রাথমিক আইন প্রনয়ণ' শব্দটি এই ব্যাতিক্রমধর্মী পদ্ধতিগুলো বাদ দিয়ে ব্যবহৃত হতে পারে।
আইন প্রণয়নে জনগণের অংশগ্রহণ
সম্পাদনাসকল আধুনিক সংবিধান এবং মৌলিক আইন জনগণের সার্বভৌমত্বের ধারণা এবং নীতি ধারণ ও ঘোষণা করে, যার অর্থ মূলত এই যে, জনগণই জনশক্তি এবং শাসন বিভাগের কর্তৃত্বের চূড়ান্ত শক্তি। জনগণের সার্বভৌমত্বের ধারণাটি কোনো রাজনৈতিক পদক্ষেপের জন্য গঠিত সমাজে সেই ব্যাপারটিই ধারণ করে, অর্থাৎ জনগণের ইচ্ছাই রাজনৈদিত পদক্ষেপের একমাত্র সঠিক মানদন্ড। চেক এন্ড ব্যালেন্স এবং প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র পদ্ধতির এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে ধরা যায়। সূতরাং, জনগণ প্রত্যক্ষভাবে আইন তৈরির প্রক্রিয়ায় অংগ্রহণেরও পরোক্ষ অধিকার আছে। শাসন বিভাগ এবং আইন প্রণেতাদের সাথে জনগণের এই সম্পর্ক ন্যায্যতার ধারণার সাথে গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত আইন প্রণয়ন পদ্ধতির উপর গণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ এবং শর্ত তৈরির প্রক্রিয়া তখনই আবির্ভাব হতে পারে যখন জনগণের জাতীয় আইন প্রণয়নকারী প্রতিষ্ঠান এবং সেটির সদস্যপদ সম্পর্কে মানুষের ধারণা খুবই অল্প থাকলে। জনগণের অংশগ্রহণ এবং আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় তাদের আত্মবিশ্বাস জড়ালো করতে নাগরিক শিক্ষা পরিকল্পনা অপরিহার্য।[৪]
মৃত পত্র
সম্পাদনা"মৃত পত্র" ("Dead letter") শব্দটি সাধারণত এমন আইন প্রণয়নকে নির্দেশ করে, যা বাতিল না করা হলেও অপ্রযোজ্য, অচল হয়ে পড়েছে বা বর্তমানে চালু নেই।[৫]
বাংলাদেশে আইন প্রণয়নের ইতিহাস
সম্পাদনা১৭৭৩ সালে ব্রিটিশ শাসন বিভাগ ব্রিটিশ পার্লামেন্টে জেনারেল গভর্নর ইন আইন প্রণয়নের ক্ষমতা প্রদান করলে এদেশে সংসদের মাধ্যমে আইন প্রণয়নের ধারণাটি প্রকাশ পায়। ১৮৮৪ সালে ভারত ব্রিটিশ পার্লামেন্টের আইন প্রণয়নের পদ্ধতি অনুযায়ী আইন প্রনয়ণ করার ক্ষমতা প্রদান করা হয়। ১৮৬১ সাল থেকে ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা লাভ করা পর্যন্ত কেন্দ্রীয় এবং প্রাদেশিক আইন পরিষদ জাতীয় এবং প্রাদেশিক আইন প্রণয়ন করত। ১৯৭১ সাল পর্যন্ত পাকিস্তান শাসনামলে শাসন বিভাগের অধীনে সংসদে আইন প্রণয়ন করা হতো। বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের এক বছর পর ১৯৭২ সালের ১৬ই ডিসেম্বর থেকে এদেশে জাতীয় সংসদ নিবার্চনের করার পদ্ধতি চালু হয়।
বাংলাদেশে আইন প্রণয়ন ব্যবস্থা
সম্পাদনা১৯৭২ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পদ্ধতি চালু করা হলে, প্রায় সকল বিল শাসন বিভাগ এবং খুবই অল্প সংখ্যক বিল বেসরকারী সদস্যের বিল সংসদীয় নীতিমালা অনুসরণ করে কোনো সংসদ সদস্যের দ্বারা উত্থাপন করা হয়। ক্যাবিনেট অনুমতি প্রদান করলে যে মন্ত্রণালয়ের দ্বারা বিলটি উত্থাপিত সেই মন্ত্রণালয়কে বিলটির চূড়ান্ত খসড়া তৈরির নির্দেশ প্রদান করা হয়। তারপর এই চূড়ান্ত খসড়া যাচাই করা হয় এবং আইন বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় উদ্যোক্তা মন্ত্রণালয়ের অনুরোধে একটি চূড়ান্ত খসড়া বিল তৈরি করবে অথবা খসড়া বিলটি আবার পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে যাচাই করা হবে। এরপর চূড়ান্ত খসড়া বিল বা যাচাইকৃত বিল উদ্যোক্তা মন্ত্রণালয়ের কাছে পাঠানো হয়। অনুমোদনের পর তা সংসদ মচিবালয়ের কাছে প্রেরণ করা হয়। আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সেই খসড়া বিলটি যাচাই করতে আইন কমিশনের কাছে সেটি প্রেরণ করওত পারে। কমিশনের প্রতিবেদন পেলে বিলটি কমিশনের পরামর্শ অনুসারে সংশোধন করা হতে পারে। এ কাজটি বিলটি উদ্দ্যোক্তা মন্ত্রণালয়ের নিকট প্রেরণের পূর্বেই করা হয়ে থাকে। অর্থ বিলের ক্ষেত্রে সেটি সংসদে উত্থানের জন্য রাষ্ট্রপতির অনুমোদন একান্ত প্রয়োজনীয় এবং রাষ্ট্রপতির অনুমতি প্রদানের বিলটি স্পীকার সংসদে বিলটি উত্থাপনের জন্য তারিখ ধার্য করেন।
কোনো বিল সংসদে উত্থাপনের পূর্বে মন্ত্রী এবং সংসদ সদস্যদের বিলটির একটি অনুলিপি প্রদান করা হয়। কোনো বিল সয়সদে উপস্থাপন করাকে ফার্স্ট রিডিং বলা হয় এবং বিলটির বিশদ আলোচনার জন্য আরো একটি তারিখ নির্ধারণ করা হয়, যাকে বিলটি সেকেন্ড রিডিং বলা হয়। এ পর্যায়ে বিলটির বিশদ আলোচনা করা হতে পারে অথবা বিলটির জনমত যাচাই করার জন্য সেটি একটি স্থায়ী বা বাছাই কমিটির নিকট প্রচার করা যেতে পারে। কোনো বিল সেকেন্ড রিডিং এর পর পাস করা হলে তাকে থার্ড রিডিং বলা হয়। কোনো স্থায়ী বা বাছাই কমিটির নিকট প্রচার করা হলে, সেই কমিটি রিপোর্টসহ বিলটি পূনরায় সংসদে প্রেরণ করবে এবং তারপর সেটি রিপোটর্সহ বিবেচনা করা হবে। গৃহীত হলে, স্পীকার সেটি সংসদে উপস্থাপন করবেন এবং বিলটি পাস করা হবে কিনা সেই বিষয়ে সংসদে একটি নির্বাচন করা হবে। নির্বাচনে বিলটি পাসের পক্ষে অধিকাংশ উপস্থিত সংসদ সদস্য ভোট প্রদান করলে বিলটি পাস করা হয় এবং স্পীকার সেটিকে সাক্ষর করেন। এরপর বিলটি রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের জন্য প্রেরণ করা হয় এবং রাষ্ট্রপতির অনুমোদন পেলে সেটি সরকারি গেজেটে জাতীয় সংসদের একটি আইন হিসেবে প্রকাশ করা হয়।উল্লেখ্য এই যে, কোনো আইন শাসন বিভাগের পরিপন্থি হতে পারে না।
রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ
সম্পাদনাসংসদের অধিবেষন না থাকলে অথবা সংসদ ভেঙে দেওয়া হলে, এমতাবস্থায় রাষ্টপতি তাৎক্ষণিক অবস্থানযায়ী কোনো পদক্ষেপ গ্রহনের প্রয়োজন বোধ করলে তিনি কোনো অধ্যাদেশ জারী করতে পারেন, যা সরকারি গেজেটে মুদ্রিত হবে। অধ্যাদেশ কখনো শাসন বিভাগের পরিপন্থি হতে পারে না। এ অধ্যাদেশ আইনের সমান ক্ষমতার অধিকারী। সংসদের প্রথম অধিবেশনের ত্রিশ দিনে এ অধ্যাদেশ অনুমোদিত না হলে এটি আর কার্যকর থাকে না।
উপ—আইন
সম্পাদনাউপ-আইন তিন প্রকার— রুল, রেগুলেশন এবং অর্ডার। এটি কখনো মূল আইনের বা অধ্যাদেশের বিপরীতে যেতে পারবে না।
- রুল: মন্ত্রণালয় কর্তৃক তৈরি সমাদিষ্ট আইনকে রুল বলে।
- রেগুলেশন: বিধিবদ্ধ স্বায়ত্বশাসিত কর্তৃপক্ষ কর্তৃক তৈরিকৃত সমাদিষ্ট আইনকে রেগুলেশন বলে।
- অর্ডার: প্রশাসনিক সংস্থা এবং স্থানীয় কর্তৃপক্ষের তৈরি সমাদিষ্ট আইন
এ আইনগুলোর প্রাথমিক খসড়া সংশ্লিষ্ট বিভাগ বা অন্য কর্তৃপক্ষের দ্বারা তৈরি এবং অনুমোদনের জন্য নিয়ন্ত্রণকারী মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা হয়। অনুমোদিত হলে, সেটি আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কাছে প্রেরণ করা হয়। খসড়াটি চূড়ান্ত হওয়ার পর যে মন্ত্রণালয় থেকে সেটি পাঠানো হয়েছিল সেই মন্ত্রণালয়ে এটি পরীক্ষা এবং চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য প্রেরণ করা হয়। অনুমোদিত হলে চূড়ান্ত খসড়া রুল বা রেগুলেশন সরকারি গেজেটে ছাপা হয়। রুল এবং রেগুলেশন কার্যকর করতে এরকম প্রকাশনা পদ্ধতি আবশ্যকীয়।
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ See Article 289(3) of the Treaty on the Functioning of the European Union
- ↑ Wim Voermans (ডিসেম্বর ২০০৯)। "Is the European Legislator after Lisbon a real Legislature?"। Legislacao Cadernos de Ciencia de Legislacao। 50: 391–413 [402]।
Within the category of legal acts provided for by the TFEU, a distinction is made between legislative acts and non-legislative acts. Legislative acts are decisions adopted under the ordinary or special legislative procedure (Article 289(3) of the TFEU) and non-legislative acts are decisions that are adopted pursuant to delegation or for the purpose of implementing a legislative act (Articles 35 See Article 288 of the TFEU, last 290 and 291 of the TFEU)
- ↑ Senate.gov
- ↑ Vértesy, László (২০১৭-০১-১০)। "The Public Participation in the Drafting of Legislation in Hungary"। Central European Public Administration Review। 14 (4)। আইএসএসএন 2591-2259। ডিওআই:10.17573/ipar.2016.4.06।
- ↑ Dead Letter
বহিঃসংযোগ
সম্পাদনা- "Legislation"। New International Encyclopedia। ১৯০৫। [[Category:উইকিপিডিয়া নিবন্ধ যাতে নিউ ইন্টারন্যাশনাল এনসাইক্লোপিডিয়া থেকে একটি উদ্ধৃতি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে]]
- Most-Viewed Bills on Congress.gov