আইনস্টাইন বলয়
আইনস্টাইন বলয় (আইনস্টাইন-চোলসন বলয় বা চোলসন বলয় হিসেবেও পরিচিত) হলো এক ধরনের মহাযাগতিক আলোক বলয় বা রিং। যখন একটি ছায়াপথ বা তারা থেকে আলো পৃথিবীর দিকে আসার সময় একটি বৃহদায়তন বস্তুকে অতিক্রম করে তখন এই ধরনের ঘটনা ঘটে। মহাকর্ষীয় লেন্সিং এর কারণে আলোর অভিমূখ পাল্টে যায় এবং মনে হয় আলোটি বিভিন্ন স্থান থেকে আসছে। যদি উৎস, লেন্স এবং পর্যবেক্ষক সারিবদ্ধ থাকে তাহলে আলো একটি বলয় আকৃতিতে দৃশ্যমান হয়।
এই ঘটনা প্রথম ১৯২৪ সালে সেন্ট পিটার্সবার্গের পদার্থবিদ ওরেস্টেস খোভলসন ড্যানিলোভিচ উল্লেখ করেন যা ১৯৩৬ সালে আলবার্ট আইনস্টাইন কর্তৃক সংখ্যায় ব্যাক্ত হয়।[১] শিক্ষাক্ষেত্রে একে সাধারণত আইনস্টাইন বলয় হিসেবে উল্লেখ করা হয় কেননা, খোভলসন বলয় বিম্বটির প্রবহণ বা ব্যাসার্ধ সম্পর্কে চিন্তা করেননি।
সূত্রপাত
সম্পাদনাআইনস্টাইন তার সাধারণ আপেক্ষিকতায় মহাকর্ষীয় লেন্সিং এর ধারণা ব্যাক্ত করেন।[২] উৎস হতে আলো সরল পথে না এসে কোনো স্থান-কাল বিকৃতকারী বৃহৎ বস্তুর প্রভাবে বেঁকে যায় (ত্রি-মাত্রিকতায়)। আইনস্টাইন বলয়, মহাকর্ষীয় লেন্সিং-এরই একটি বিশেষ পরিস্থিতি যা উৎস, লেন্স এবং পর্যবেক্ষকের একেবারে সঠিক সারিবদ্ধতার কারণে ঘটে। ইহা লেন্সের প্রতিসাম্যে একটি বলয়াকৃতি সৃষ্টি করে।[৩]
একটি আইনস্টাইন বলয়ের আকার, আইনস্টাইন ব্যাসার্ধ প্রদত্ত হয়। রেডিয়ানে, ইহা এরকম হয়ঃ
যেখানে,
- হলো মহাকর্ষ ধ্রুবক,
- হলো লেন্সের ভর,
- হলো আলোর গতিবেগ,
- হলো লেন্সের কৌনিক ব্যাস দুরত্ব,
- হলো উৎসের কৌনিক ব্যাস দুরত্ব, and
- হলো লেন্স ও উৎসের মাঝের কৌনিক ব্যাস দুরত্ব।[৪]
লক্ষ্য করুনঃ মহাকর্ষীয় দুরত্বের ক্ষেত্রে সাধারণভাবে ।
দূরবর্তী এবং অস্পষ্ট বস্তু দেখার জন্য আইনস্টাইন বলয় খুবই কাজের কেননা এরা বস্তুকে বিবর্ধিত করে।[৫] ২০১৫ সালে, আলমা টেলিস্কোপ ও আইনস্টাইন বলয়ের সমন্বয়ে বিজ্ঞানিরা ১১.৪ আলোক বর্ষ দূরের এইচএটিএলএএস জে০৯০৩১১.৬+০০৩৯০৬ নামক ছায়াপথকে পর্যবেক্ষণ করেন।[৬]
ইতিহাস
সম্পাদনাআইনস্টাইন ১৯১৬ সালে তার সাধারণ আপেক্ষিকতা প্রকাশের আগেই ১৯১২ সালে, একটি মহাকর্ষীয় বস্তু দ্বারা আলোর অবনমনের ভবিষ্যদ্বাণী করেন। ওরেস্টেস খোভলসন ড্যানিলোভিচ ১৯২৪ সালে অ্যাকাডেমিক শিক্ষায় বলয়ের প্রভাবটি প্রথম উল্লেখ করেন যেখানে তিনি উৎস, লেন্স এবং পর্যবেক্ষক প্রায় নিখুঁতভাবে সারিবদ্ধ হলে মহাকর্ষের "বর্ণবলয় প্রভাবের" (হ্যলো ইফেক্ট) কথা উল্লেখ করেন।[৮] ১৯৩৬ সালে একজন চেক প্রকৌশলী, রুডি ডব্লিউ ম্যান্ডেলের অনুরোধ কৃত একটি চিঠির জবাবে আইনস্টাইন এই বলয় প্রভাব সম্পর্কে মন্তব্য করেন এবং বলেন,
অবশ্যই, সরাসরি এই ঘটনাটি পর্যবেক্ষণ করার কোনো আশা নেই। প্রথমত, আমরা খুব কমই এ জাতীয় কেন্দ্রীয় রেখার যথেষ্ট কাছাকাছি যেতে পারি। দ্বিতীয়ত, কোণ β আমাদের যন্ত্রগুলির সমাধানের শক্তিকে প্রতিহত করবে।
— সায়েন্স খণ্ড ৮৪ পৃ ৫০৬ ১৯৩৬
(এখানে, β হলো আইনস্টাইন ব্যাসার্ধ যা বর্তমানে দ্বারা প্রকাশ করা হয়।) যাইহোক, আইনস্টাই শুধুমাত্র তারা ঘটিত আইনস্টাইন বলয়ের কথা বিবেচনা করেন যার সম্ভনা সত্যই কম। যদিও, বড় লেন্স যেমন ছায়াপথ বা কৃষ্ণগহ্বর কর্তৃক সৃষ্ট বলয় দেখতে পাওয়ার সম্ভবনা বেশি কেননা, আইনস্টাইন বলয়ের কৌনিক আকার লেন্সের ভর বৃদ্ধির সাথে সাথে বৃদ্ধি পায়।
জ্যাকলিন হুইট ও তার দল ১৯৮৭ সালের শুরুর দিকে ভিএলএ দিয়ে এমজি১১৩১+০৪৫৬ নামক একটি রেডিও উৎস পর্যবেক্ষণের সময় প্রথম আইনস্টাইন বলয়ের দেখা পান। এই পর্যবেক্ষণে একটি ছায়াপথ কর্তৃক লেন্স কৃত একটি নিকটবর্তী আপাত-নক্ষত্রের দুইটি প্রায় একই রকম বিম্ব দেখতে পাওয়া যায় যা লেন্সটির চারপাশে প্রায় একটি পূর্ণ বলয় তৈরী করেছিল।[৯]
প্রথম পূর্ণ আইনস্টাইন বলয়ের দেখা পাওয়া যায় ১৯৯৮ সালে যা হাবল স্পেস টেলিস্কোপ ও মারলিন যৌথ ভাবে আবিষ্কার করে। বি১৯৩৮+৬৬৬ নামক একটি উপবৃত্তাকার ছায়াপথ এক্ষেত্রে লেন্স হিসেবএ কাজ করে। আলোক উৎসটি ছিলো একটি অন্ধকার বামন স্যাটেলাইট গ্যালাক্সি যা বর্তমান প্রযুক্তি দ্বারা এই প্রভাব ব্যতীত দেখাই যেতো না।[১০][১১]
আমরা এখন পর্যন্ত কোনো তারা ঘটিত আইনস্টাইন বলয় পর্যবেক্ষণ করতে পারিনি। তবে, ২০২৮ সালের মে মাসে একটি তারা ঘটিত আইনস্টাইন বলয় দেখার প্রায় ৪৫% সম্ভবনা রয়েছে যখন আলফা সেন্টরাই এ আমাদের (পৃথিবী) ও একটি দূরবর্তী লহিত তারার মাঝ দিয়ে যাবে।[১২]
দ্বৈত আইনস্টাইন বলয়
সম্পাদনারাফায়েল গাওয়াজি ও টমাসো ট্রিউ ২০০৮ সালে হাবল স্পেস টেলিস্কোপ ব্যবহার করে একটি দ্বৈত আইনস্টাইন বলয় আবিষ্কার করেন যা এসডিএসএসজে০৯৪৬+১০০৬ নামক লেন্সে সঙ্ঘটিত হয়। ইহা ৩, ৬ ও ১১ বিলিয়ন আলোক বর্ষ দূরের তিনটি গ্যালাক্সির আলো থেকে উদ্ভূত হয়।[১৩]
আরও দেখুন
সম্পাদনাতথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ Gravity Lens – Part 2 (Great Moments in Science, ABS Science)
- ↑ Overbye, Dennis (মার্চ ৫, ২০১৫)। "Astronomers Observe Supernova and Find They're Watching Reruns"। The New York Times। সংগ্রহের তারিখ মার্চ ৫, ২০১৫।
- ↑ Drakeford, Jason; Corum, Jonathan; Overbye, Dennis (মার্চ ৫, ২০১৫)। "Einstein's Telescope - video (02:32)"। The New York Times। সংগ্রহের তারিখ ডিসেম্বর ২৭, ২০১৫।
- ↑ Pritchard, Jonathan। "Gravitational lensing" (পিডিএফ)। Harvard and Smithsonian। পৃষ্ঠা 19। সংগ্রহের তারিখ ২১ ডিসেম্বর ২০১৯।
- ↑ Howell, Elizabeth। "Hubble Telescope Discovers a Light-Bending 'Einstein Ring' in Space"। SPACE.com।
- ↑ Redd, Nola Taylor (২০১৫-০৫-১০)। "Einstein Ring Reveals Explosion of Star Birth in Deep Universe (Video)"। SPACE.com।
- ↑ "ALMA at Full Stretch Yields Spectacular Images"। ESO Announcement। সংগ্রহের তারিখ ২২ এপ্রিল ২০১৫।
- ↑ Turner, Christina (ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০০৬)। "The Early History of Gravitational Lensing" (পিডিএফ)। জুলাই ২৫, ২০০৮ তারিখে মূল (পিডিএফ) থেকে আর্কাইভ করা।
- ↑ "Discovery of the First "Einstein Ring" Gravitational Lens"। NRAO। ২০০০। সংগ্রহের তারিখ ২০১২-০২-০৮।
- ↑ "A Bull's Eye for MERLIN and the Hubble"। University of Manchester। ২৭ মার্চ ১৯৯৮।
- ↑ Browne, Malcolm W. (১৯৯৮-০৩-৩১)। "'Einstein Ring' Caused by Space Warping Is Found"। The New York Times। সংগ্রহের তারিখ ২০১০-০৫-০১।
- ↑ P. Kervella; ও অন্যান্য (অক্টো ১৯, ২০১৬)। "Close stellar conjunctions of α Centauri A and B until 2050"। Astronomy & Astrophysics। 594: A107। arXiv:1610.06079 । ডিওআই:10.1051/0004-6361/201629201।
- ↑ Gavazzi, Raphael; ও অন্যান্য (এপ্রিল ২০০৮)। "The Sloan Lens ACS Survey. VI: Discovery and Analysis of a Double Einstein Ring"। The Astrophysical Journal। 677 (2): 1046–1059। arXiv:0801.1555 । ডিওআই:10.1086/529541। বিবকোড:2008ApJ...677.1046G।
সাময়িকী
সম্পাদনা- Cabanac, R. A.; ও অন্যান্য (২০০৫)। "Discovery of a high-redshift Einstein ring"। Astronomy and Astrophysics। 436 (2): L21–L25। arXiv:astro-ph/0504585 । ডিওআই:10.1051/0004-6361:200500115। বিবকোড:2005A&A...436L..21C। (refers to FOR J0332-3357)
- Chwolson, O (১৯২৪)। "Über eine mögliche Form fiktiver Doppelsterne"। Astronomische Nachrichten। 221 (20): 329–330। ডিওআই:10.1002/asna.19242212003। বিবকোড:1924AN....221..329C। (The first paper to propose rings)
- Einstein, Albert (১৯৩৬)। "Lens-like Action of a Star by the Deviation of Light in the Gravitational Field" (পিডিএফ)। Science। 84 (2188): 506–507। ডিওআই:10.1126/science.84.2188.506। পিএমআইডি 17769014। বিবকোড:1936Sci....84..506E।[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ] (The famous Einstein Ring paper)
- Hewitt, J (১৯৮৮)। "Unusual radio source MG1131+0456 - A possible Einstein ring"। Nature। 333 (6173): 537–540। ডিওআই:10.1038/333537a0। বিবকোড:1988Natur.333..537H।
- Renn, Jurgen; Sauer, Tilman; Stachel, John (১৯৯৭)। "The Origin of Gravitational Lensing: A Postscript to Einstein's 1936 Science paper"। Science। 275 (5297): 184–186। ডিওআই:10.1126/science.275.5297.184। পিএমআইডি 8985006। বিবকোড:1997Sci...275..184R।
- King, L (১৯৯৮)। "A complete infrared Einstein ring in the gravitational lens system B1938 + 666"। MNRAS। 295 (2): L41–L44। arXiv:astro-ph/9710171 । ডিওআই:10.1046/j.1365-8711.1998.295241.x। বিবকোড:1998MNRAS.295L..41K।
সংবাদ
সম্পাদনা- Barbour, Jeff (২০০৫-০৪-২৯)। "Nearly perfect Einstein ring discovered"। Universe Today। সংগ্রহের তারিখ ২০০৬-০৬-১৫। (refers to FOR J0332-3357)
- "Hubble Finds Double Einstein Ring"। Science Daily। ২০০৮-০১-১২। সংগ্রহের তারিখ ২০০৮-০১-১৪।
তদতিরিক্ত পড়ুন
সম্পাদনা- Kochanek, C. S.; Keeton, C. R.; McLeod, B. A. (২০০১)। "The Importance of Einstein Rings"। The Astrophysical Journal। 547 (1): 50–59। arXiv:astro-ph/0006116 । ডিওআই:10.1086/318350। বিবকোড:2001ApJ...547...50K।