অন্নদামঙ্গল

ভারতচন্দ্র রচিত একটি মঙ্গলকাব্য

অন্নদামঙ্গল রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র রচিত একটি মঙ্গলকাব্য। বাংলা সাহিত্যের অন্ধকার যুগের অবসানে মঙ্গলকাব্যের সূচনা হয়। কবি বুঝেছিলেন মঙ্গলকাব্যের দীর্ঘ অবয়বে বাংলা সাহিত্য জরাজীর্ণ। তাই তিনি মঙ্গলকাব্যের আদিকবিদের অনুসরণে কাব্য রচনা শুরু করলেও কাব্যের রচনাশৈলী অনস্বীকার্য ভাবে অভিনব। কাব্যটি দেবী অন্নপূর্ণার মাহাত্ম্য্যব্যঞ্জক। ১৭৫২ খ্রিষ্টাব্দে ভারতচন্দ্র এই কাব্য রচনা করেছিলেন।[][] ভারতচন্দ্রের পৃষ্ঠপোষক নদিয়ারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায় বাংলায় প্রতিমায় দেবী অন্নপূর্ণার পূজা প্রচলন করেন। তিনিই ভারতচন্দ্রকে রায়গুণাকর উপাধি প্রদান করে দেবীর মাহাত্ম্যব্যঞ্জক একটি কাব্য রচনার অনুরোধ করেন।[] সমগ্র কাব্যটি তিনটি খণ্ডে বিভক্ত: (ক) অন্নদামঙ্গল বা অন্নদামাহাত্ম্য্য,[] (খ) বিদ্যাসুন্দর বা কালিকামঙ্গল ও (গ) মানসিংহ বা অন্নপূর্ণামঙ্গল[]। মঙ্গলকাব্য ধারায় অন্নদামঙ্গল কাব্যকে একটি পৃথক শাখা রূপে গণ্য করা হয় না; কারণ ভারতচন্দ্র ভিন্ন অপর কোনো কবি এই বিষয়বস্তু অবলম্বন করে কাব্য রচনা করেননি।[]

দেবী অন্নপূর্ণা, কালীঘাটের পটচিত্রে, ১৯০০ খ্রিস্টাব্দ

সমগ্র অন্নদামঙ্গল কাব্যের কোনো প্রাচীন নির্ভরযোগ্য পুঁথি পাওয়া যায় না। প্রাপ্ত পুঁথি গুলির লিপিকাল ১৭৭৬-১৮২৯ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যবর্তী সময়। ১৮১৬ খ্রিষ্টাব্দে এই কাব্যটি প্রথম মুদ্রিত হয়।[] ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ১৮৪৭ ও ১৮৫৩ সালে এই গ্রন্থের দুটি সংস্করণ প্রকাশ করেন।[] পরবর্তীকালে বিদ্যাসাগর কৃত সংস্করণটি আদর্শ ধরে অন্নদামঙ্গল কাব্যের অন্যান্য সংস্করণগুলি প্রকাশিত হয়।[] লন্ডনের ব্রিটিশ মিউজিয়াম, প্যারিসের বিবলিওথেক নাসিওনেল দে ফ্রান্স, এশিয়াটিক সোসাইটিবঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদে এই কাব্যের কয়েকটি প্রাচীন পুঁথি সংরক্ষিত আছে।[]

ভারতচন্দ্র স্বয়ং অন্নদামঙ্গল কাব্যকে "নূতন মঙ্গল" অভিধায় অভিহিত করেছেন। কবি এই কাব্যে প্রথাসিদ্ধ মঙ্গলকাব্য ধারার পূর্ব ঐতিহ্য ও আঙ্গিককে অনুসরণ করলেও, বিষয়বস্তুর অবতারণায় কিছু নতুনত্বের নিদর্শন রেখেছেন। অন্যান্য মঙ্গলকাব্যের ন্যায় অন্নদামঙ্গল গ্রামীণ পটভূমি বা পরিবেশে রচিত হয়নি; এই কাব্য একান্তই রাজসভার কাব্য।[] ভারতচন্দ্র এই কাব্যের আখ্যানবস্তু সংগ্রহ করেছিলেন কাশীখণ্ড উপপুরাণ,[] মার্কণ্ডেয় পুরাণ, ভাগবত পুরাণ,[] বিহ্লনের চৌরপঞ্চাশিকা (চৌরীসুরত পঞ্চাশিকা),[] এবং ক্ষিতীশবংশাবলীচরিতম্[] ইত্যাদি গ্রন্থ ও লোকপ্রচলিত জনশ্রুতি থেকে। অন্নদামঙ্গল কাব্যের বৈশিষ্ট্য হল ছন্দ ও অলংকারের সুদক্ষ প্রয়োগ। সংস্কৃত ভাষায় পারঙ্গম ভারতচন্দ্র প্রাচীন সংস্কৃত কাব্যের বিভিন্ন ছন্দ ও অলংকার সার্থকভাবে এই কাব্যে প্রয়োগ করেন।[] এই কারণে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই কাব্য সম্পর্কে মন্তব্য করেন,

অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে:

কাব্যের বিষয়বস্তু

সম্পাদনা

অন্নদামঙ্গল কাব্য তিনটি খণ্ড নিয়ে গঠিত। এগুলো হল - ১. অন্নদামঙ্গল, ২. কালিকামঙ্গল বা বিদ্যাসুন্দর কাব্য এবং ৩. মানসিংহ।

অন্যান্য মঙ্গলকাব্যের মতো অন্নদামঙ্গল খণ্ডে দেবী অন্নদার মাহাত্ম্য বর্ণিত হয়েছে। সতীর দেহত্যাগ, শিব-পার্বতীর বিবাহ প্রভৃতি পৌরাণিক কাহিনী এই খণ্ডের প্রথমে বলা হয়েছে। এরপরে বসুন্ধর ও নলকুবেরের হরিহোড় ও ভবানন্দ মজুমদার রূপে মর্তে আগমন , দেবীর হরিহোড়ের গৃহে প্রবেশ , এরপর দেবীর হরিহোড়ের গৃহত্যাগ ও ভবানন্দের গৃহে আগমন প্রভৃতি কাহিনী বর্ণিত হয়েছে।

২য় খণ্ড বিদ্যাসুন্দরের সঙ্গে মূল কাহিনীর কোনো সম্পর্ক নেই। এখানে বর্ধমানের রাজকন্যা বিদ্যা ও কাঞ্চীর রাজকুমার সুন্দর এর প্রেমকাহিনী বর্ণিত হয়েছে। এই খণ্ডে দেবী কালিকার মাহাত্ম্য প্রচারিত হয়েছে।

৩য় খণ্ডে মানসিংহ , ভবানন্দ মজুমদার , প্রতাপাদিত্যের কাহিনী আছে।

আলোচনা

সম্পাদনা

অন্নদামঙ্গল কাব্যকে ভারতচন্দ্র নূতন মঙ্গল বলেছেন। ত্রয়োদশ শতক থেকে অষ্টাদশ শতকের মধ্যে রচিত মঙ্গলকাব্য গুলির থেকে অন্নদামঙ্গল কাব্য তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্যের জন্য স্বাতন্ত্র্য লাভ করেছে। মঙ্গলকাব্য গুলির মত দেবদেবীর মাহাত্ম্য প্রচারের সঙ্গে সঙ্গেই ভবানন্দ মজুমদারের মাহাত্ম্যও প্রচারিত হয়েছে।

সমগ্র কাব্যের মধ্যে প্রথম খণ্ডটিই সর্বোৎকৃষ্ট। ভাষা - ছন্দ- অলঙ্কারের ব্যবহার কৌশলে ভারতচন্দ্র মধ্যযুগের সকল কবিকে ছাড়িয়ে গেছেন। তাঁর কাব্যের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল সুস্পষ্ট সমাজচিত্র অঙ্কন।

প্রথম সচিত্র গ্রন্থ

সম্পাদনা
 
১৮১৬ খ্রি. প্রকাশিত অন্নদামঙ্গল গ্রন্থের সচিত্রকরণ: ‘সুন্দর চোর ধরা’।

১৭৭৮ খ্রিষ্টাব্দে মুদ্রাঙ্কিত অর্থাৎ প্রেসে ছাপা প্রথম বাংলা বই প্রকাশিত হয়। এর বহু পরে প্রকাশিত হয় ‘অন্নদামঙ্গল’, ১৮১৬ খ্রিষ্টাব্দে। এটি বাংলা ভাষার প্রথম সচিত্র গ্রন্থ। বাঙালি শিল্পীদের আঁকা ৬টি ছবি এই গ্রন্থের সচিত্রকরণে ব্যবহৃত হয়েছিল।

পাদটীকা

সম্পাদনা
  1. মদনমোহন গোস্বামী (সংকলিত ও সম্পাদিত), ভারতচন্দ্র, সাহিত্য অকাদেমি, নতুন দিল্লি, ১৯৬১ (২০০৬ মুদ্রণ), পৃ. ৮-১৩
  2. অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত, তৃতীয় খণ্ড: দ্বিতীয় পর্ব, মডার্ন বুক এজেন্সি প্রাঃ লিঃ, কলকাতা, পৃ. ১৪৭-৬১
  3. ড. ক্ষেত্র গুপ্ত, বাংলা সাহিত্যের সমগ্র ইতিহাস, গ্রন্থনিলয়, কলকাতা, ২০০১, পৃ. ১৮২-৮৭
  4. ড. পার্থ চট্টোপাধ্যায়, বাংলা সাহিত্য পরিচয়, তুলসী প্রকাশনী, কলকাতা, ২০০৮, পৃ. ১৫৬-৬৬
  5. অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত, তৃতীয় খণ্ড: দ্বিতীয় পর্ব, মডার্ন বুক এজেন্সি প্রাঃ লিঃ, কলকাতা, পৃ. ১৬১-৮৭
  6. অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত, তৃতীয় খণ্ড: দ্বিতীয় পর্ব, মডার্ন বুক এজেন্সি প্রাঃ লিঃ, কলকাতা, পৃ. ১৮৭-২০৬
  7. "কবিসঙ্গীত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর"। ৪ মার্চ ২০১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৩ মার্চ ২০১০